যাকাত আদায়ে মানুষের সম্পদকে পবিত্র করে!

13

হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী :

ইসলাম ধর্ম পাঁচটি ভিত্তির উপর স্থাপিত।এ গুলোর মধ্যে ‘যাকাত’ অন্যতম ভিত্তি। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন অর্থাৎ এবং তোমরা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য যাকাত আদায় করো। অত:পর তিনি উহা দ্বিগুণ করে দিবেন। (সূরা: আর-রুম, আয়াত: ৩৯)
যাকাত আদায়ের ব্যাপারে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ পাক যাকাত দেয়া ফরয করেছেন যেন তোমাদের অবশিষ্ঠ সম্পদকে নির্দোশ বা নির্বিঘ্ন করে দিতে পারেন। (আবু দাউদ শরীফ)।
যাকাত কাকে বলে : যাকাতের আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। যাকাত যেহেতু অর্থ সম্পদকে পুঁজিবাদের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করে, মানুষের মন-মস্তিষ্ককে গর্ব-অহংকার, লোভ-লালসা ও কৃপণতার মলিনতা তেকে পরিচ্ছন্নতা রাখে। এবং নিজের উপার্জিত সম্পদে সমাজের অবহেলিত শ্রেণীর দাবী-দাওয়া পূরণে উৎসাহ যোগায় এজন্য ইসলামের এই তৃতীয় স্তম্ভে নামকরণ হয় যাকাত। শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদ মুসলমান গরীবকে আল্লাহর ওয়াস্থে পুরোপুরি মালিক বানিয়ে দেয়াকে যাকাত বলে।
ধনী সম্পদশালী ব্যক্তিরা মনে করেন যে যাকাতের দ্বারা সম্পদ কমে যায় তা নিছক ভুল ধারণা। কেননা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কালামে পাকে ওয়াদা করেছেন যে, যাকাত আদায়ের ফলে তিনি তার প্রিয় বান্দাদের সম্পদ দ্বিগুণ করে দিবেন।
যাকাত অস্বীকারকারীর হুকুম : যাকাত ইসলামের অন্যতম খুঁটি। কোরআন-হাদিসে যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে বারবার তাগিদ করা হয়েছে। কোরআন-হাদিসের অকাট্য প্রমাণাদি দ্বারা যাকাতের বিধান প্রণোদিত হয়েছে। তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ কারো নেই। যাকাত অস্বীকারকারীকে শরিয়ত কাফির বলে আখ্যা দিয়েছে। কেননা ফরজের বিধান অস্বীকার করা কুফুরির অন্তর্ভুক্ত।
যে তা আদায় না করবে সে ফাসিক এবং ক্বাতল হওয়ার যোগ্য। আর যে আদায় করতে বিলম্ব করবে সে গুনাহগার তার সাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। (আলমগীরি: তরিকুল ইসলাম বাংলা ২য় খন্ড, পৃ. ২৬৫)
যাকাতের হিসাব যে মাস থেকে : যাকাত আরবি (চন্দ্র মাসের) হিসাবানুযায়ী আদায় করতে হবে। বছরের যে কোন মাসে যাকাত আদায় করলে হয়। তবে আদায় করার সময় নিয়ত করা শর্ত।
যাকাত যেভাবে আদায় করবে : পাঠকগনের সুবিদার জন্য আজ আমি সরল-সরল ও সাবলিল ভাষায় যাকাতের হিসাব দশ টাকা থেকে লক্ষ টাকা পর্যন্ত যাকাত কত টাকা আসবে। নিম্নে টাকা-পয়সার হিসাব বিস্তারিত প্রদত্ত করলাম। এ দিকে লক্ষ্য রেখে আদায় করলে কোন অসুবিদা হবেনা বলে আমি আশাবাদী।
আনুগ্রহ করে আল্লাহর অফুরন্ত রহমতের আশা নিয়ে দোযখের আযাবের ভয় অন্তরে রেখে সময়মত যাকাত আদায় করুন।
যাকাতের হিসাব নিম্নরূপ:
টাকার পরিমাণ যাকাতের হিসাব প্রদত্ত টাকা/পয়সা
১,০০,০০০/= এক লক্ষ টাকায় ২৫০০/=
৫০,০০০/= পঞ্চাশ হাজার টাকায় ১২৫০/=
১০,০০০/= দশ হাজার টাকায় ২৫০/=
১০০০/= এক হাজার টাকায় ২৫/=
৯০০/= নয়শত টাকায় ২২.৫০/=
৮০০/= আটশত টাকায় ২০/=
৭০০/= সাতশত টাকায় ১৭.৫০/=
৬০০/= ছয়শত টাকায় ১৫/=
৫০০/= পাঁচশত টাকায় ১২.৫০/=
৪০০/= চারশত টাকায় ১০/=
৩০০/= তিনশত টাকায় ০৭/=
২০০/= দুইশত টাকায় ০৫/=
১০০/= একশত টাকায় ০২.৫০/=
বি.দ্র: উপরোক্ত যাকাতের হিসাবানুযায়ী আপনার নিকট যত লক্ষ টাকা, যত হাজার টাকা, যত শত টাকা বা যত টাকা-পয়সা থাকবে আপনি এর যাকাত বের করতে হিমশিম খেতে হবে না।
মুসলমান ভাই-বোনেরা! কৃপণতা করবেন না। সম্পদ আপনার একা নয়। কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার শত্রু। দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয়পাত্র।
ব্যবসায়ী মালের যাকাতের মাসআলা : ব্যবসার মাল যদি নেসাব পরিমাণ হয় অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা সোনা ও বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রোপা অথবা সমপরিমাণ নগদ অর্থ হয় তবে সে মালের উপর যাকাত ফরজ। শতকরা আড়াই টাকা হিসাবে যাকাত আদায় করতে হবে।
যাকাত সংক্রান্ত মাসআলা : সোনা হোক বা রূপা, সবধরনের ব্যবসায়ী মালে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে বিক্রয় মূল্যই গ্রহণযোগ্য ক্রয় মূল্য নয়। যেমন কারো নিকট যাকাতের যা মাল বর্তমানে আছে তার ক্রয় মূল্য ১ লক্ষ টাকা। কিন্তু বিক্রয় মূল্য ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। উক্ত মালের ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকার উপরই যাকাত ওয়াজিব।
যাকাত প্রদানের স্থান সমূহ : গরীব এতিম মিসকিনকে যাকাত প্রদান করতে হবে। মিসকিন ফকির বলতে সেসব মুসলিম নর-নারী বুঝায় যাদের নিকট জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় বিষয়াদি যেমন: অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির ব্যবস্থা নেই অথবা আছে তবে তা প্রয়োজন মেটাবার নয়।
ঋণগ্রস্ত মানুষ যার নিকট ঋণ পরিশোধ করার উপায় নেই। সেসব নিস্বঃ নওমুসলিম যাদের মন জয় করা মুসলমানদের দরকার। আল্লাহর পথের মুজাহিদগণ যারা দুস্থ এবং নিঃস্ব হওয়ার কারণে জিহাদে অংশগ্রহণ থেকে বিরত। অথবা সেসব হাজীগণ যাদের টাকা-পয়সা ও পাথেয় শেষ হওয়ার কারণে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করতে অপারগ।
মাসআলা : যাকাতের এই খাত সমূহ ব্যতিত অন্যস্থানে ব্যয় করা বৈধ হবে না। যেসব দ্বীনি মাদ্রসা গুলোর ‘লিল্লাহ ফান্ড তথা গরীব ফান্ড’ রয়েছে তাতে যাকাতের অর্থ দেয়া জায়েয অন্যথায় জায়েয হবে না।
মাসআলা : যাকাতের টাকা দিয়ে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারী, হাসপাতালের ডাক্তার এবং অন্যান্য কর্মচারীবৃন্দের বেতন/ভাতা আদায় করা জায়েয হবে না। (জাওয়াহিরুল ফাতওয়া ১ম খন্ড হতে সংকলিত)
যাকাত ফরজের দার্শনিক ভিত্তি : যাকাত ইসলামের ৩য় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। নামাজের পরেই যাকাতের স্থান। নামাজ হল শারীরিক ইবাদত যা ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল মুসলমানের উপর ফরজ। আর যাকাত হল আর্থিক এবাদত যা কেবল নেসাব পরিমাণ মালের অধিকারী ব্যক্তির উপর ফরজ।
ইসলামী শরিয়ত ধনীদের জন্য যাকাতকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফরজ রূপে নির্দ্দিষ্ট করেছে। যাতে নামাজ সহ অন্যান্য শারীরিক এবাদতের মত এই আর্থিক এবাদত দ্বারা ঈমানে সজিবতা, আত্মার পরিচ্ছন্নতা এবং আল্লাহর নেয়ামতের শোকর গোজারীর প্রবণতা জাগে এবং তদ্দারা আল্লাহর নেকট্য অর্জিত হয়, তাঁর দয়াদান আরও বৃদ্ধি পায়। ইসলাম যাকাতের বিধান প্রবর্তন করে। ধনী ও গরীব লোকের মধ্যে এমন এক সামঞ্জস্য স্থাপন করেছে যে, অবস্থাপন্ন মুসলমানগণ যদি সামগ্রিকভাবে যাকাত আদায় করে, তবে মুসলমান সমাজে একদিকে লাগামহীন পঁজিবাদের কবর রচনা হয়, আর অন্যদিকে ক্ষুধার্ত, বস্তুহারা মানুষদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। ফলে মানব জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে এমন এক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় যাতে বর্তমান যুগের শ্রেণীগতদ্বন্দ সংঘাতের অস্তিত্বই বাকি থাকে না।
পরিশেষে, আমি উভয় জাহানের মালিক মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করি তিনি যেন বাংলার প্রত্যেক সম্পদশালী মুসলমান নর-নারীকে যথাযথভাবে সঠিক নিয়মে যথাস্থানে গরীব-দুঃখির দিকে নজর রেখে যাকাত আদায় করার তৌফিক দান করেন। আল্লাহুম্মা আমিন।
সূত্র পঞ্জিকা-
১. আল-কোরআনুল কারীম।
২. বুখারী শরিফ।
৩. আবু দাউদ শরিফ।
৪. তরিকুল ইসলাম (২য় খন্ড)।
৫. জাওয়াহিরুল ফতোয়া।