ফ্রি ফায়ার ও পাবজি গেমের ‘ডায়মন্ড’ কিনে অর্থ খোয়াচ্ছে শিশু-কিশোররা

30

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা মহামারীতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ফুটবল-ক্রিকেটের বদলে বেছে নিচ্ছে অনলাইনভিত্তিক মোবাইল গেমস। বিশেষ করে ‘ফ্রি ফায়ার ও পাবজি’ গেম কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের মধ্যে ভয়ঙ্কর আসক্তি তৈরি করছে। এ দুটি গেম শিক্ষার্থী-কিশোর-কিশোরীদের সহিংস করে তুলছে। এসব গেমের উপকরণ (ডায়মন্ড) সহজে বিক্রির জন্য তৈরি হয়েছে একটি মধ্যস্বত্বভোগী চক্র। এরা ফেসবুকে গ্রুপ ও পেজ খুলে বিকাশ এবং নগদের মাধ্যমে এসব উপকরণ বিক্রি করছে। এছাড়া তরুণ-তরুণীরা লাইকি-টিকটকের অশ্লীল ভিডিওতে নাচ, গান ও অভিনয়ের পাশাপাশি নিজেদের ধূমপান ও সিসা গ্রহণ করার ভিত্তিও আপলোড করছে। স্মার্টফোন ব্যবহার করে অনলাইনে করছে মাদক বেচাকেনা। অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিশোরদের এ ভয়ঙ্কর আসক্তি থেকে ফেরানো না গেলে জাতিকে চড়া মাশুল গুনতে হতে পারে। পৃথিবীর বহু দেশ এসব এ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশেও এসব এ্যাপ নিষিদ্ধ করতে হবে। এছাড়া ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিরাপদে রাখতে আইন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করার দাবি জানান তারা।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির এক প্রতিবেদন বলছে, দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা মোট ১১ কোটি ৬১ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে ১০ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক তরুণসমাজ। কিন্তু এর অপব্যবহারের কারণে দ্রুত ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। বাবা-মার উৎসাহ বা অবহেলার কারণে শিশুরা খুব কম বয়সে বিভিন্ন গেমে আসক্ত হচ্ছে। করোনাকালে কিশোরদের অপরাধপ্রবণতাসহ গ্যাং কালচারের আসক্তি বেড়েছে। লকডাউনে অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোরদের অপরাধের ধরনও অনেকটা বদলেছে। এ সময় অপরাধের সঙ্গে নতুন মাত্রা দিয়েছে প্রযুক্তি। শিশু-কিশোররা অনলাইন ঘেঁটে শুধু শিক্ষামূলক কনটেন্টই দেখছে এমন নয়। সামাজিক প্রেক্ষাপটে যায় না এমন অনেক অনৈতিক কনটেন্টও সার্চ করছে। নিজেদের জীবনেও তার প্রয়োগ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসএ্যাপ, ভাইবার, ইমোর বিভিন্ন গ্রুপে পরিকল্পনা হয় গ্যাং কালচারের। কোথায় কখন আড্ডা হবে, কতগুলো বাইক/গাড়ি থাকবে, কোন এলাকায় অবস্থান নিতে হবে, এমনকি কোথায় বসে কোন ধরনের মাদক গ্রহণ করবে, তা-ও ঠিক করে ফেলছে ঘরে বসে এসব গ্রুপে। অভিভাবক এবং আইন প্রয়োগাকারী সংস্থার সদস্যরাও টের পান না তাদের এসব পরিকল্পনার।
‘সম্প্রতি শিশু-কিশোরদের ওপর একটি সমীক্ষা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে কিশোর-কিশোরীরা স্মার্টফোনকেন্দ্রিক ইন্টারনেটের সুযোগকে অপব্যবহার করছে। তাই অন্তত এইচএসসি পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীদের কাছে স্মার্টফোন না দেয়ার পরামর্শ অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদের। জানতে চাইলে ডিএমপির সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশেনের এডিসি মোঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘প্রযুক্তি অপরাধ নিয়ে আমরা কাজ করছি। এছাড়া সিআইডি ও র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। দেশের ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট যেভাবে হচ্ছে, প্রযুক্তির অপরাধগুলোও সেভাবে আসছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি। পাশাপাশি কেউ অভিযোগ করলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ ডিএমপির সাইবার সংশ্লিষ্ট তথ্যে জানা গেছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট, পর্নোগ্রাফি আইন, আইসিটি আইন টেলিকমিউনিকেশন এ্যাক্ট আইনে সারাদেশে ২০১৫ সালে ৬৩৮টি, ২০১৬ সালে ৯২৩টি, ২০১৭ সালে ১০৪৫টি, ২০১৮ সালে ১১৬৫টি, ২০১৯ সালে ১৫০৭টি এবং ২০২০ সালে ১৪৫৯টি মামলা হয়। প্রযুক্তি অপব্যবহার ক্রমেই বেড়ে যাওয়ায় এই মামলাগুলোর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সাইবার বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এ্যান্ড টেকনোলজির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানভীর জোহা খান বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক কেন্দ্রিক অপরাধ যেভাবে দিন দিন বাড়ছে, সেখানে ফেসবুকের ‘এডিটিং প্যানেল’ বাংলাদেশে নিয়ে আসা খুবই জরুরী। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ফেসবুক এডিটিং প্যানেল রয়েছে। তিনি বলেন, বিটিআরসির উচিত হবে তাদেরই তৈরি ‘প্যারেন্টাল গাইড লাইন’ সংক্রান্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নের দিকে যাওয়া। এতে করে শিশু ও কিশোররা প্রযুক্তির অপব্যবহার করতে একটু ভয় পাবে।
‘ফ্রি ফায়ার ও পাবজি’ গেমে ভয়ঙ্কর আসক্তি কিশোর-কিশোরীদের ॥ গেরিনা ফ্রি ফায়ার (ফ্রি ফায়ার ব্যাটলগ্রাউন্ডস বা ফ্রি ফায়ার নামেও পরিচিত) একটি ব্যাটল রয়্যাল গেম। ২০১৯ সালে এটি বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক ডাউনলোড করা মোবাইল গেম। গেমটি অন্য খেলোয়াড়কে হত্যা করার জন্য অস্ত্র এবং সরঞ্জামের সন্ধানে একটি দ্বীপে প্যারাসুট থেকে পড়ে আসা ৫০ জন ও তার অধিক খেলোয়াড়কে অন্তর্ভুক্ত করে। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে বন্দুক দিয়ে মসজিদে মুসলমানদের হত্যা এবং সেই দৃশ্য ফেসবুক লাইভের বিষয়টি অনেকেই পাবজির সঙ্গে তুলনা করেন। অনলাইনভিত্তিক সহিংস গেম বিশ্বজুড়ে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে। বিশেষ করে কিশোরদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। জরিপ প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার এক হিসাবে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে শীর্ষে থাকা পাবজি আয় করেছে ৭৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার, দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে ফ্রি ফায়ার আয় করেছে ২৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার, কল অব ডিউটির মোবাইল সংস্করণ আয় করেছে ১৮ কোটি ২০ লাখ ডলার, নাইভস আউট আয় করেছে ১৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
দেশে এ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে খেলা এই গেমের উপকরণ সরাসরি কিনতে হলে ক্রেডিট কার্ডে ডলার কিংবা পেপালের মতো কারেন্সি থাকা প্রয়োজন। পাশাপাশি গুগল প্লেস্টোরে এ্যাকাউন্টও থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দেশের কিশোর-কিশোরদের তো এসব এ্যাকাউন্ট নেই, তাহলে তারা গেমের উপকরণ কিনছে কীভাবে? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গেমের উপকরণ সহজে বিক্রির জন্য তৈরি হয়েছে একটি মধ্যস্বত্বভোগী চক্র। উপকরণ বলতে এক ধরনের ডিজিটাল ডায়মন্ডকে বোঝায়। যারা এই গেম খেলেন তারা ডায়মন্ড কিনে একজন আরেকজনকে গিফট করে থাকেন। এসব ডায়মন্ড কেনাবাচায় ফেসবুকে গ্রুপ ও পেজ খুলে বিকাশ এবং নগদের মাধ্যমে এসব উপকরণ বিক্রি করছে বিভিন্ন চক্র। তবে অনলাইন গেমিংয়ে কিশোরদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় গেম হচ্ছে ‘পাবজি’। বিনামূল্যে ডাউনলোডযোগ্য গেমটির রয়েছে মোবাইল এবং লাইট সংস্করণ। মূলত দেশের কিশোরদের কাছে এখন পাবজির পরই ফ্রি ফায়ার গেম সবচেয়ে প্রিয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে দেশে তরুণ প্রজন্মের মাঝে জনপ্রিয় ফ্রি ফায়ার ও পাবজি। দক্ষিণ কোরিয়ার গেম ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ব্লু হোয়েলের অনলাইন ভিডিও ২০১৭ সালে চালু হয়। এরপর থেকে এই গেমটি দ্রুত বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ২০১৯ সালে চায়না প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা যুদ্ধ গেম ফ্রি ফায়ার একইভাবে তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই গেম দুটির অপব্যবহারের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। এরা চরমভাবে বিপথগামী হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, বিশেষ করে করোনা মহামারীর ফলে স্কুল, কলেজ, ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে অন্যদিকে অনলাইনভিত্তিক ক্লাস হওয়ার ফলে অভিভাবকরা তার সন্তানদের হাতে ল্যাপটপ, মোবাইল ডিভাইস তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ সুযোগের বেশির ভাগ অপব্যবহার ঘটছে। এমনকি তরুণ প্রজন্ম এই গেম দুটির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে।
টিকটক-লাইকি এ্যাপে বিপথগামী তরুণ প্রজন্ম : সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ভারতে এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় বাংলাদেশী যুবকের জড়িত থাকার প্রমাণ পায় পুলিশ। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তরুণী ও অভিযুক্ত সবাই রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকার ‘টিকটক হৃদয় বাবু’ গ্যাং গ্রুপের সদস্য। ভারতীয় পুলিশ তাদের গ্রেফতার এবং ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, প্রায় ২০-২২ বছর বয়সী একটি মেয়েকে বিবস্ত্র করে ৩/৪ জন যুবক শারীরিক ও যৌন নির্যাতন চালাচ্ছে। ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের কেরালায়। পরে টিকটক হৃদয় সেই ভিডিও ভারতের বিভিন্ন বন্ধুদের কাছে শেয়ার করেন। এরপর সেই ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। পুলিশ বলছে, এরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নারীদের সঙ্গে প্রতারণা করত। একই সঙ্গে বিদেশে মানব পাচারেও এরা জড়িত। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানে ইংরেজী মাধ্যম স্কুল মাস্টারমাইন্ডের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিন ওরফে শাহনূরী হত্যাকান্ড সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। তদন্তে উঠে আসে, গ্রেফতার ইফতেখার ফারদিন দিহান ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি দেখে সেক্স ফ্যান্টাসিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। আনুশকার সঙ্গে বিপজ্জনক বিকৃত যৌনাচারে ফরেন বডি বা সেক্স টয় ব্যবহার করে সে।