আল-কুরআনে উদ্ধৃত আম্বিয়া (আ:) উম্মতের দোয়া

22

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর মোনাজাত : মিসর-অধিপতির স্ত্রী হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই একথা রাষ্ট্র হয়ে যায় যে, আযীযের স্ত্রী তাঁর ক্রীতদাসের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েছে। আযীযের স্ত্রী এ দুর্নাম অপনোদনের জন্য মিসরের নারীদেরকে দাওয়াত করলেন মিসরের নারীগণ হযরত ইউসুফের রূপ-গরিমা দেখে অভিভূত হয়ে গেল। সকলেই হযরত ইউসুফের প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়লো এবং তাঁকে বললো, তুমি আযীযের স্ত্রীর আনুগত্য কর। ঈমানের এরূপ কঠিন পরীক্ষার মুহূর্তে হযরত ইউসুফ (আঃ) আল্লাহপাকের মহান দরবারে দু’আ করলেন, ‘‘হে আমার প্রতিপালক, এই নারীরা আমাকে যার প্রতি আহবান করেছে তা অপেক্ষা কারাগার আমার নিকট অধিক প্রিয়’’ (সূরা-ইউসুফ-৩৩)। আল্লাহপাক হযরত ইউসুফের এই বিনীত প্রার্থনা কবুল করেছেন।
হযরত ইউসুফকে তাঁর ভাইয়েরা কেনআনের কূপে ফেলে দিয়েছিল। আল্লাহপাক তাঁকে কূপ থেকে উদ্ধার করে মিসর নিয়ে গেলেন। মিসরে এক মিথ্যা অপবাদে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে মিসরের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে দিলেন। পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দীর্ঘ দিন পর তাঁর সাক্ষাৎ হল। তিনি ইহকালীন জীবনে সর্বাদিক থেকে আল্লাহপাকের রহমত ও নেয়ামত লাভ করার পর জীবনসায়াহ্নে এসে আল্লাহপাকের নিকট নিবেদন করলেন, ‘‘কাসাসুল কুরআন ১/২৯৫;’’। ‘‘হে আমার রব, আপনি আমাকে রাজ্য দান করেছেন এবং স্বপ্ন ও অন্যান্য কথার ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। হে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর ¯্রষ্টা, আপনিই ইহলোক ও পরলোকে আমার অভিভাবক। আপনি আমাকে মুসলিম হিসেবে মৃত্যু দিন এবং আমাকে সৎ কর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করুন’’ (সূরা-ইউসূফ-১০১)।
হযরত শুয়াইব (আঃ)-এর প্রার্থনা : মাদাইয়ানবাসীর নিকট হযরত শুয়াইব আলাইহিস সালাম নবীরূপে প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর কওমকে বললেন, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর। তোমরা পরিমাপ ও ওজন ঠিকভাবে দিও। আল্লাহর প্রতি যারা ঈমান আনে, তাদেরকে আল্লাহর পথে বাধা দিও না। তখন তাঁর সম্প্রদায়ের দাম্ভিক ও অতি দুরাচার নেতৃবর্গ বললো, হে শুয়াইব, তোমরা আমাদের ধর্মাদর্শে ফিরে না আসলে আমরা তোমাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে অবশ্যই বহিষ্কার করে দেব। তখন হযরত শুয়াইব আল্লাহপাকের সাহায্য প্রার্থনা করে বললেন, ‘‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের অপরাধীদের মধ্যে ন্যায্যভাবে মীমাংসা করে দিন এবং আপনিই মীমাংসাকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ’’ (সূরা-আরাফ-৮৯)। আল্লাহপাক তাঁর দোয়া কবুল করে অপরাধীদের ধ্বংস করে দিলেন।
হযরত মূসা (আঃ)-এর দোয়া : হযরত মূসা (আঃ)- একবার মিসরের এক পথ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে দেখতে পেলেন, জৈনিক স্থানীয় ব্যক্তি একজন ইসরাঈলীর উপর জুলুম করছে। তিনি সে স্থানীয় ব্যক্তিকে প্রথমত জুলুম থেকে বিরত থাকতে বললেন, কিন্তু সে তাঁর কথা অমান্য করল। তিনি তৎক্ষাণাৎ এই অপরাধীকে হাত দিয়ে আঘাত করলেন। তাতে সে মারা গেল। হযরত মূসা (আঃ)-এর তাকে হত্যা করার ইচ্ছা ছিলনা। তিনি সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত হলেন এবং বললেন, নিশ্চয় এটি শয়তানের কাজ। তারপর তিনি ,আল্লাহ পাকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, ‘‘হে প্রভু আমি নিজের উপর জুলুম করেছি। অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন’’ (সূরা- কাসাস ১৬)। আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা করে দিলেন। তিনি তখন তওবা করে বললেন, ‘‘হে আমার প্রতিপালক, যেহেতু আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, আমি কখনো অপরাধীদের সাহায্যকারী হব না’’ (সূরা- কাসাস ১৭)।
হযরত মূসা (আঃ) কর্তৃক জনৈক মিসরী কিবতীকে হত্যার সংবাদ দ্রুতবেগে জানাজানি হয়ে গেল। ফেরাউনের পরিষদবর্গ হযরত মূসা (আঃ)কে হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাঁকে খুঁজতে শুরু করলো। তিন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সেখান থেকে বের হয়ে পড়লেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, ‘‘হে আমার রব, আপনি জালেম সম্প্রদায় থেকে আমাকে রক্ষা করুন’’ (সূরা-কাসাস ২১)।
হযরত মূসা (আঃ) মিসর থেকে পালায়ন করে লোহিত সাগরের পূর্ববর্তী অঞ্চল মাদাইয়ানে চলে আসলেন। তাঁর জন্য মাদাইয়ান সম্পূর্ণ নতুন জায়গা। পথ-ঘাট ও মানুষজন একেবারে অপরিচিত। তিনি মুসাফির, কপর্দকহীন। এমন অসহায় অবস্থায় তিনি আল্লাহ পাকের মহান দরবারে বিনয়াবনত হয়ে প্রার্থনা করেন।
‘‘হে আমার পালনকর্তা, আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করবেন, আমি তারই কাঙ্গাল। আল্লাহপাক তাঁর দোয়া কবুল করলেন। আল্লাহ পাকের নবী হযরত শুয়াইবের গৃহে স্থায়ীভাবে তাঁর থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
আলাহ তাআলা হযরত মূসা (আঃ)কে নবুওয়াত দান করে সর্বাগ্রে ফেরাউনের নিকট দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে যাওয়ার জন্য বললেন। কারন সে সীমাহীন উদ্ধত নাফরমান ও স্বৈরাচারী। সে চরম পর্যায়ের দাম্ভিকতাবশত বনী ইসরাঈলকে গোলাম বানিয়ে রেখেছে। এত বড় জালেম ও অহংকারী বাদশাহর নিকট দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে যাওয়ার মতো কঠিন দায়িত্ব পেয়ে হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করলেন, ‘‘হে আমার প্রতিপালক, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন। আমার জিহবার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে ’’ (সূরা-ত্বহা ২৫-২৮)।
হযরত মূসা (আঃ)-এর ভাষায় জড়তা ছিল। ফেরাউনের নিকট স্পষ্ট ভাষায় দাওয়াত পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে তখন তিনি তাঁর মনের ও কথার শক্তি বৃদ্ধির জন্য একজন সহযোগী প্রার্থনা করে আল্লাহপাকের নিকট দোয়া করলেন, ‘‘আমার জন্য আমার স্বজনবর্গের মধ্যে থেকে একজন সাহায্যকারী স্থির করুন, আমার ভ্রাতা হারুনকে, তাঁর দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় করুন এবং তাকে আমার কর্মে অংশীদার করুন। যাতে আমরা প্রচুর পরিমাণে আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে পারি এবং আপনাকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করতে পারি। আপনি তো আমাদের সম্যক দ্রষ্টা’’ (সূরা-ত্বহা-২৯-৩৫)। আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা (আঃ)-এর উভয় দোয়াই কবুল করেন।
হযরত মূসা (আঃ) যখন আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের জন্য হেদায়তের গ্রন্থ হিসেবে তাওরাত গ্রহণ করতে তুর পাহাড়ে গমন করলেন, তখন বনী ইসরাঈল গোষ্ঠী সামেরী নামক মুনাফিকের পরমর্শে বাছুরপূজা শুরু করল। হযরত মূসা (আঃ) তাওরাত নিয়ে তাদের নিকট পৌঁছার আগেই আল্লাহ পাক তাকে একথা জানিয়ে দেন। তিনি ক্রদ্ধ ক্ষুব্ধ হয়ে এসে প্রথমেই তাঁর স্থলাভিষিক্ত আপন ভাই হযরত হারুন (আঃ) এর কেশাগ্র স্পর্শ করে টানতে শুরু করলেন। হযরত হারুন আলাইহিস সালাম বললেন, তাদেরকে আমি বাধা দিয়েছি। কিন্তু তারা আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে। সে কঠিন মুহূর্তে আমি খুব অসহায়ত্ব বোধ করেছি। সুতরাং আমার সঙ্গে এমন কোন আচরণ করো না যার ফলে শত্রুরা খুশি হয়। আর আমাকে জালেমদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করো না। হযরত মূসার ক্রোধ প্রশমিত হলে তিনি আল্লাহ পাকের নিকট দোয়া করলেন, ‘‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে ও আমার ভ্রাতাকে ক্ষমা করুন এবং আমাকে আপনার রহমতের মধ্যে দাখিল করুন। আর আপনিই শ্রেষ্ঠ দয়ালু’’ (সূরা-আরাফ-১৫১)।
আল্লাহতাআলা হযরত মূসা (আঃ)কে শরীয়াত হিসেবে তাওরাত দেয়ার জন্য প্রথমে ত্রিশ দিন পরে আরও দশ দিন বৃদ্ধি করে মোট চল্লিশ দিন সিয়ামসহ ই’তেকাফের মতো একই স্থানে ধ্যানমগ্ন থাকতে বললেন। হযরত মূসা (আ.) শর্তসহ মেয়াদ পূর্ণ করে যখন নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলেন, তখন আল্লাহপাক নূরের পর্দার অন্তরাল থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন। হযরত মূসা (আঃ) তখন আল্লাহ পাককে সরাসরি দেখার প্রার্থনা করে বলেছিলেন, ‘‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে দর্শন দিন, আমি আপনাকে দেখবো’’ (সূরা- আরাফ-১৪৩)।
আল্লাহপাক হযরত মূসাকে বললেন, তুমি আমাকে ইহকালে কখনই দেখতে পাবে না। তুমি বরং পাহাড়ের প্রতি লক্ষ্য কর। তা স্বস্থানে স্থির থাকলে আমাকে দেখতে পাবে। যখন আল্লাহতাআলা পাহাড়ের ওপর তাঁর নূর প্রকাশ করলেন, তখন পাহাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল, আর মূসা (আঃ) সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন। মূসা (আঃ) জ্ঞান ফিরে পেয়ে আল্লাহপাকের নিকট তওবা করে প্রার্থনা করলেন- ‘‘হে আল্লাহ, আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। আমি অনুতপ্ত হয়ে আপনার নিকট প্রত্যাবর্তন করলাম এবং মুমিনদের মধ্যে আমিই প্রথম’’ (সূরা- আরাফ-১৪৩)। (অসমাপ্ত)