যুব সমাজের প্রতি প্রধানমন্ত্রী ॥ চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরী করুন

27
গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন প্রান্তে যুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদক, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত না হতে দেশের যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এই ধরনের কোন কাজের সঙ্গে কেউ যেন সম্পৃক্ত না হয়। হয়ত তাৎক্ষণিক নগদ মোটা টাকা দিতে পারে। কিন্তু আসলে এখানে কোন জীবনের নিশ্চয়তা থাকে না। আর মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের কিন্তু কঠোর অবস্থানটা বজায় থাকবে, এটা মাথায় রাখতে হবে। আর চাকরির পেছন না ছুটে নিজেকে কীভাবে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করা যায়, সেই চিন্তা মাথায় রেখে যুবকদের দেশ গঠনের কাছে এগিয়ে যেতে হবে।
শীতের আগমনে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাব বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিমানবন্দরসহ সব প্রবেশ পথে বাধ্যতামূলক পরীক্ষা এবং বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টাইনে রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আবার সময় এসে গেছে, যারা বাইরে থেকে আমাদের দেশে আসবেন তাদের পরীক্ষা করা, কোয়ারেন্টাইনে রাখা- এটা আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি পোর্টে আগের মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশে কেউ ঢুকতে গেলেই করোনাভাইরাস নিয়ে ঢুকছে কিনা- সেটা পরীক্ষা করতে হবে। কারণ আমাদের দেশের মানুষের সুরক্ষা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। রবিবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব দিবস-২০২০-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এমন নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের মূল অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন এবং বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব দিবসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
আজকে যারা তরুণ-যুবক, ভবিষ্যতে এই দেশটি তারাই পরিচালনা করবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ’৭৫ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত ২১ বছর’ এবং পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক পরবর্তী আরও ৮ বছর জাতির জীবন থেকে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা অনুষ্ঠানে স্মরণ করিয়ে দেন। ’৭৫-এর পর দেশ যে অবস্থায় ছিল, সে রকম ব্যর্থতায় পুনরায় পর্যবসিত হোক তার সরকার চায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সে রকম অন্ধকার যুব আর বাংলার মানুষের জীবনে যেন না আসে। তারা যে আলোর পথে আজ যাত্রা শুরু করেছে, সেটাই যেন আমরা ধরে রাখতে পারি।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে এ বছরের বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পুরস্কার বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। ২১ জন স্বনির্ভর যুবক এবং ৫টি সফল যুব সংগঠন যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ এ পুরস্কার দেয়া হয়। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আখতার হোসেন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। পুরস্কার বিজয়ীদের পক্ষে সাইফুর রহমান এবং সামিয়া রহমান অনুষ্ঠানে নিজ নিজ অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
এ সময় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মহাপরিচালক আখতারুজ্জামান খান কবিরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় গণভবন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তার কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব দিবস-২০২০ উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট এবং খাম ও অবমুক্ত করা হয়। ‘মুজিবর্ষের আহ্বান, যুব কর্মসংস্থান’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে সারাদেশে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে।
চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেকে কীভাবে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করা যায়, সেই চিন্তা মাথায় রেখে কাজ করার জন্য অনুষ্ঠান থেকে যুব সমাজের প্রতি এ আহ্বান জানিয়ে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বলেন, একটা ডিগ্রী নিয়েই চাকরির পেছনে না ছুটে নিজে কীভাবে কিছু করা যায়, নিজে কাজ করব, আরও দশ জনকে চাকরি দেব, নিজে উদ্যোক্তা হব, নিজেই বস হব। এই কথাটা মাথায় রাখতে হবে যে, ‘আমি বস হব, আমি কাজ দেব। আমাদের মধ্যে সেই শক্তিটা আছে, সেই শক্তিটা আমি কাজে লাগাব। এই চিন্তাটা মাথায় যেন থাকে আমাদের যুবকদের।’
যুব সমাজের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি, আমাদের তো সময় শেষ। কিন্তু যুবকরাই তো আসলে দেশের প্রাণ সঞ্চার করবে। কাজেই সেইভাবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে যাক, আমি সেটাই চাই। দেশ আলোর পথে যে যাত্রা শুরু করেছে, তা যেন অব্যাহত থাকে। দেশ যেন আর সেই অন্ধকারের দিকে ফিরে যেতে না পারে।
শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জাতির পিতার আজীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার কথাও আবেগজড়িত কণ্ঠে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘যদি তিনি (বঙ্গবন্ধু) বেঁচে থাকতেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা যদি বাঙালীর জীবনে না ঘটত, তাহলে স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে পারত। সেইভাবেই তিনি পরিকল্পনা নিয়েছিলেন এবং কর্মসূচী বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি এবং যারা হানাদার বাহিনীর দোসর, তাদের চাটুকার, খোশামদি, তোষামদি করত যারা, তারাই কিন্তু জাতির পিতাকে হত্যা করে সেই অগ্রযাত্রাটা ব্যাহত করে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যুব সমাজই যে সবার আগে প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছিল, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সে কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সব সময় একটা লক্ষ্য, জাতির পিতার যে আদর্শ, সেই আদর্শ সামনে নিয়ে আমাদের যুব সমাজকে আমরা গড়ে তুলব এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের আমরা গড়ে তুলব। এই বাংলাদেশ যেন একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে মর্যাদা নিয়ে বিশ্বে এগিয়ে যেতে পারে, আর সেই সঙ্গে আমাদের দেশটা যেন আত্মনির্ভরশীল এবং আত্মমর্যাদাশীল হয়।
যুব সমাজের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বয়সটা হলো কাজের বয়স, চিন্তার বয়স, মেধা বিকাশের সময়। আজকে যারা যুবক, আগামীদিনে তারাই দেশের কর্ণধার হবে; আজকে যে শিশুটি জন্ম নিল, তার ভবিষ্যত যেন উন্নত হয়, সে কথা চিন্তা করেই সরকার সব পদক্ষেপ নিচ্ছে। আর আওয়ামী লীগ যখনই সরকারে এসেছে, তরুণদের কর্মসংস্থানের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এক সময় দেশে একটি টেলিভিশন ও একটা রেডিও স্টেশন ছিল। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে তার সরকার বেসরকারী খাতকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
করোনাভাইরাসের কারণে দেশের সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনোভাইরাসের কারণে আজকে সারাবিশ্ব স্থবির হয়ে পড়েছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। সেই সঙ্গে আহ্বান করেছি আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। সেখানেও আমরা আমাদের যুব সমাজকে ধন্যবাদ জানাই। যখন ধান কাটা নিয়ে সমস্যা ছিল তখন আহ্বান করলাম, আমাদের ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ থেকে শুরু করে সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিনি বলেন, যে কোন কাজেরই মর্যাদা আছে। যে জিনিস খেয়ে আমাদের জীবন বাঁচে আর সেই ফসলের মাঠে কাজ করলে কারও মর্যাদাহানি হয় না। বরং এই কাজ করে কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর ফলে মনে করি আমাদের ছাত্র এবং যুবকদের সম্মান জাতির কাছে, আন্তর্জাতিকভাবেও অনেক অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবেই মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
নিজের কাজ নিজে করতে কোন লজ্জা নেই উল্লেখ করে শেখ হাসিনা আরও বলেন, মাদক-জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস বা এ ধরনের কোন কাজের সঙ্গে কেউ যেন সম্পৃক্ত না হয়। হয়ত তাৎক্ষণিকভাবে নগদ মোটা টাকা দিতে পারে। কিন্তু আসলে এখানে কোন জীবনের নিশ্চয়তা থাকে না। আর এর বিরুদ্ধে আমাদের যে কঠোর অবস্থান, মাদক সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ দুর্নীতি এর বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থানটা কিন্তু খুব কঠোর থাকবে, এটা মাথায় রাখতে হবে। সব জায়গায় একটা জবাবদিহিতা থাকতে হবে এবং দেশকে ভালবাসতে হবে। দেশের মানুষের প্রতি একটা দায়িত্ববোধ থাকতে হবে এবং এই দায়িত্ববোধটা নিয়েই আগামী দিনে চলতে হবে, সেটাই আমরা চাই।
দালালের খপ্পরে পরে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে নিজের জীবনকে অনিশ্চিতের মধ্যে না ফেলার জন্য যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানানোর পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার দিকে তার সরকারের গুরুত্ব দেয়ার কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারিগরি শিক্ষা হলে পর দেশে বিদেশে কাজ করার সুযোগ হয়। সেখানেও আমার যুবকদের প্রতি একটি আহ্বান থাকবে, কারণ আমরা জানি অনেক সময় দালালদের খপ্পরে পড়ে জমি-জমা বিক্রি করে দিয়ে লাখ লাখ টাকা দিয়ে বিদেশে ছুটে যায় সোনার হরিণ ধরতে; তারপর দেখা যায় সেখানে তো না কাজ পাওয়া যায়, না চাকরি পাওয়া যায়, অকাতরে জীবনটা দিতে হয়।