জাতীয় বীমা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ॥ বীমা প্রযুক্তিনির্ভর করলে দুর্নীতি দূর হবে

12
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ১ম জাতীয় বীমা দিবস এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বীমা কোম্পানীর স্টল পরিদর্শন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বীমা খাতকেও প্রযুক্তিনির্ভর এবং দুঃসময়ে বীমা থাকার বিভিন্ন সুবিধা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য বীমা কোম্পানিগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বীমাকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। বীমার যে কোন কিছু অর্থাৎ বীমার দাবি নিষ্পত্তি থেকে শুরু করে বীমা সেবা আরও সহজ করতে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। এটা করলে পরে দুর্নীতি দূর হবে। এর থেকে মানুষ উপকার পাবে। পৃথিবীর সব দেশে এখন আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে। সেই ক্ষেত্রে আমি মনে করি, আমাদের দেশেও পুরো বীমা সিস্টেমটাকে একটা ডিজিটাল পদ্ধতিতে আপনারা দাঁঁড় করাবেন।
রবিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় বীমা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী রাজনীতির পাশাপাশি জীবিকার প্রয়োজনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বীমা কোম্পানিতে কাজ করার কথা উল্লেখ করে বীমা শিল্পের উন্নয়নে সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশের সব বীমা প্রতিষ্ঠানকে অটোমেশন পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসায় বীমা খাতের অনেক উন্নতি হবে। সঙ্গে সঙ্গে অনেক সমস্যাও সমাধান হবে। কেউ আর কর ফাঁকি দিতে পারবে না। দেশের রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে।
সরকার প্রধান আরও বলেন, আমাদের দেশে আসলে বীমা সম্পর্কে সচেতনতা খুবই কম। এই বীমার মাধ্যমে কিন্তু বহু মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে। এ সময় শৈশবের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমরা ছোটবেলায় শুনতাম যে কী চাকুরি করে, ওই অমুক বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে চাকরি করে। কারণ বীমা এনে দিলেই তারা একটা টাকা পেত। এটা একটা ভাল অর্থ উপার্জনের পথ ছিল। কিন্তু এখন সেই জিনিসটা একটু কম। আমি মনে করি, এটা আবার ফিরে আসা উচিত।
বীমা কোম্পানির মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বীমা কোম্পানিগুলোর উচিত এই বীমাটাকে আরও মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া। এখন আমাদের গ্রাম পর্যায়ের মানুষ কিন্তু অনেক সচেতন। কাজেই সেদিকে আমরা মনে করি যে মানুষের মধ্যে আরও আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে আরও সক্ষম হবেন। তিনি বলেন, প্রত্যেকেরই ইন্স্যুরেন্সটা করা থাকলে পরে তাদের যে সুবিধাটা হয় সেটা একটু দেখা দরকার এবং এক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতিটা এখন কার্যকর করা দরকার।
এক সময় পোশাক কারখানাগুলোতে ঘন ঘন আগুন লাগার ঘটনায় ইন্স্যুরেন্সের টাকার যোগসূত্র থাকার দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি যেটা বলি, খুব সত্য বলি। একটা সময় পোশাক কারখানাগুলোতে ঘন ঘন আগুন লাগত। এত আগুন কেন লাগত? ইন্স্যুরেন্সের টাকা পাওয়ার জন্য আগুন লাগে না তো? আমি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তদন্ত করালাম, কিছু কিছু ধরাও পড়ল। আপনাদের হয়তো খেলায় আছে, স্বাধীনতার পরপর পাটের গুদামে-কারখানায় আগুন লাগত। তারা ইন্স্যুরেন্সের টাকা পেত। দেখা যেত, পাট বিক্রি করে আগুন দিয়ে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে মোটা অঙ্কের ডিমান্ড দিয়ে মোটা টাকা হাতিয়ে নিত। ঠিক একই ধরনের ঘটনা বাংলাদেশেও পোশাক কারখানার অনেক ক্ষেত্রে ঘটেছে।’
বীমা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন কারখানায় আগুন লাগলে আপনারা যাদের পরিদর্শনে পাঠিয়ে থাকেন, তাদের ভাল প্রশিক্ষণ থাকতে হবে, সৎ মানুষ হতে হবে। গ্রাহক যেন ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়ামটা ঠিকমতো দেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আবার বীমার টাকাটা যেন সঠিকভাবে পান, সেটাও দেখতে হবে। যতটুকু ক্ষতি, ততটুকুই বীমা পাবে। ফাঁকি দিয়ে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার এই প্রবণতাটা দূর করতে হবে।
বীমা খাতে ‘এ্যাকচুয়ারি’ সঙ্কটের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের আরেকটা সমস্যা আমরা দেখি এ্যাকচুয়ারি পাওয়া যায় না। আমরা সরকার গঠন করার পর লন্ডন থেকে একজনকে নিয়ে আসলাম। কিন্তু তিনি দু’বারের বেশি থাকতে পারেন না। কিন্তু এ্যাকচুয়ারি দরকার সার্বক্ষণিক। এ বিষয়ে যারাই পড়ালেখা করে, বিশেষ করে লন্ডনে পড়ালেখা করলে এত বড় চাকরি পেয়ে যায় যে, দেশে আসতে চায় না। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, দক্ষ জনশক্তির গড়ার জন্য জাতির পিতা একাডেমি তৈরি করে দিয়ে গেছেন। কিন্তু আমরা কেন এটা করতে পারছি না? প্রয়োজনে শর্ত দিয়ে নিজেদের অর্থ খরচ করে পড়ালেখা করিয়ে পেশাদার এ্যাকচুয়ারির সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ আমরা উৎক্ষেপণ করেছি, সারাদেশে ব্রড ব্র্যান্ড ইন্টারনেট সার্ভিস চালু করেছি, মোবাইল ফোন সকলের হাতে হাতে, ফোরজি আমরা চালু করেছি। আমি বলব বীমাটাকে আপনারা আরও মানুষের কাছে নিয়ে যান। এখন আমাদের গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত মানুষ কিন্তু অনেক সচেতন। কাজেই সেদিকে থেকে আমরা মনে করি তাহলে মানুষের আরও আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, দেশের সব বীমা প্রতিষ্ঠানকে অটোমেশন পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসলে বীমা খাতের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ সমস্যার সমাধান হবে এবং কেউ কর ফাঁকি দিতে পারবে না। ফলশ্রুতিতে বীমার গ্রাহকদেরও আস্থা এবং বিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে। বীমা খাতের প্রিমিয়ামসহ দেশের রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বীমা গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণে ‘স্টেট-অব-দি-আর্ট টেকনোলজি’ সম্পন্ন ‘ইউনিফাইড মেসেজিং প্লাটফর্ম’ (ইউএমপি) পদ্ধতি চালু করেছে। যা গ্রাহকদের আস্থা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
বীমার উন্নয়নে তার সরকারের পদক্ষেপসমূহ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন এবং জীবন বীমা কর্পোরেশনকে পেশাদারিত্ব এবং প্রযুক্তিগতভাবে আরও সক্ষম করতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সব বীমা প্রতিষ্ঠানকে অটোমেশন পদ্ধতির আওতায় আনা এবং এজন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী হাসতে হাসতে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বীমা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। আমরা জন্যও যেন একটা চাকরি থাকে। এ সময় মঞ্চে বসে থাকা একজনের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, রিটায়ার্ড করার পর একটা চাকরি চাই। তার আগে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ১৯৬০ সালের ১ মার্চ আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে বঙ্গবন্ধু একটা পদে যোগ দেন। কন্ট্রোল অব এজেন্সি হিসেবে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। এখনকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ছিল তখনকার জিন্নাহ এভিনিউ, ওখানে বঙ্গবন্ধু অফিস পান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফিসার হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শাখা অফিসে যাওয়ার সুযোগে গোপনে গোপনে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সক্রিয়তা বজায় রেখেছিলেন জাতির পিতা। যেহেতু রাজনীতি নিষিদ্ধ কিন্তু ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির একজন অফিসার হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রসার ঘটানো। সেই সূত্র ধরে বঙ্গবন্ধু সারাদেশ সফর করতেন। এতে একসঙ্গে দুটি কাজই হতো। চাকরির পাশাপাশি গোপনে রাজনৈতিক কর্মকা-ও চালাতেন বঙ্গবন্ধু।
সবাইকে মুজিববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসুন সকলে মিলে আমরা সেই প্রত্যয় ব্যক্ত করি যে জাতির পিতা যে দেশ আমাদের দিয়ে গেছেন, এই বাংলাদেশকে আমরা উন্নত, সমৃদ্ধ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলব। জাতির পিতার স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করব।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বীমা খাতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ ব্যক্তির মাঝে ‘বীমা পদক’ বিতরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির (আইডিআরএ) ‘বীমা ম্যানুয়েল’ এবং ‘বীমা নির্দেশিকা’ নামক দুইটি বইয়ের মোড়কও উন্মোচন করেন। দেশের বীমা খাতের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে অনুষ্ঠানে একটি ভিডিও চিত্র পরিবেশিত হয়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ আশরাফুল ইসলাম এবং আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।