আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

22

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে কবি অতুলপ্রসাদ সেন ‘মোদের গরব, মোদের আশা’ কবিতায় লিখেছেন-‘মোদের গরব, মোদের আশা,/আ মরি বাংলা ভাষা!/তোমার কোলে তোমার বলে কতই শান্তি ভালবাসা’। এমন কত অসাধারণ কবিতা গল্প উপন্যাস রচিত হয়েছে মায়ের ভাষাকে ঘিরে তার হিসাব বলা মুশকিল। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী এরপর ’৫২ থেকে ’৭১ সাল পর্যন্ত বীরদর্পে বাঙালীকে শাসন শোষণ করে গেছে। লুটে নিয়েছে এই বাংলার ধন সম্পদ। কিন্তু তাদের সেই দর্পচূর্ণ করে মহান স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ’৫২ সালে বাংলার ছাত্র জনতা মায়ের ভাষা রক্ষা করার জন্য যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল-ঠিক একইভাবে ’৭১ সালেও পাকিদের কাছ থেকে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনে বীর বাঙালী।
পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর একটাই ইচ্ছে ছিল বাঙালীকে অশিক্ষিত করে রাখা। তারা যাতে সরকারী বেসরকারী কোন চাকরিতে যেতে না পারে। ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু’ গ্রন্থে আবুল মনসুর আহমদ ‘বাংলা ভাষাই হইবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক তার দুই পৃষ্ঠার লেখায় বলেছেন, ‘উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি অশিক্ষিত ও সরকারী চাকরির অযোগ্য বনিয়া যাইবেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পার্সির জায়গায় ইংরেজীকে রাষ্ট্রভাষা করিয়া ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদ মুসলিম শিক্ষিত সমাজকে রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারী কাজের ‘অযোগ্য’ করার পরিকল্পনা ছিল।
বদরুদ্দীন উমরের লেখা ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি-১ খ-ে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৪৮ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব আর্টস এবং সায়েন্স এক যুক্ত বৈঠকে সিদ্ধান্ত করেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত সমস্ত স্কুল কলেজের নিম্নতম থেকে আইএ পর্যন্ত সকল ক্লাসেই মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করা হবে। সংবাদপত্রের খবরে আরও জানা যায় যে, ১৯৫০-৫১ সেশন থেকেই এই প্রস্তাব কার্যকরী করা হবে বলে তারা সিদ্ধান্ত নেন। এ বিষয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে একটি পরিভাষা কমিটিও গঠন করা হয়। পরে ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর মাহমুদ হাসান সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে বক্তৃতা দেয়ার সময় ভাষা প্রসঙ্গে বলেন, ‘একমাত্র মাতৃভাষা ছাড়া আর কোন ভাষাই পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যববহৃত হইতে পারে না।’
ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিকই ছিল। পরে এটা সারাদেশেই বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে পড়ে। ভাষার প্রশ্নে কুমিল্লা, টাঙ্গাইল ও পাবনায় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। পাবনায় ’৫২’র জানুয়ারি মাসেই স্থানীয় সংবাদপত্র প্রতিনিধি সমিতি এক সভায় বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করার দাবি জানান। এ ছাড়া এই দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন গঠন করার জন্যেও তারা একটি স্বতন্ত্র প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাঙ্লার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (তৃতীয় খ-) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ১৯৫২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ‘প্রাদেশিকতা’ শীর্ষক নামে করাচী থেকে প্রকাশিত মুসলিম লীগ সমর্থক ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা ‘ডন’ এর একটি সম্পাদকীয়তে প্রাদেশিকতাকে পাকিস্তানের সব থেকে বড় শত্রুরূপে আখ্যায়িত করা হয় এবং পূর্ব বাংলার ভাষা প্রসঙ্গে উত্থাপন করে বলা হয়, ‘ভাষা প্রশ্নে যুবকদের কাছে একটা আবেগময় আবেদন আছে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে একটি খুব শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর পর ১৯৪৮ এর মার্চ মাসে ঢাকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সমানে ভাষা প্রসঙ্গে জিন্নাহর উক্তি উদ্ধৃত করে সম্পাদকীয়টিতে বলা হয় যে, সে সময় কেউ সেই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন যখন সেই একই কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করেন তখন সেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের উদ্দেশে ধর্মঘট করেছে বলে জানা গেছে। কার প্রভাবে এই ছাত্রদের জাতির পিতার বিরুদ্ধে এই অসম্মান প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে সেটা কি স্পষ্ট নয়? এই প্রভাব যা আসলে পাকিস্তানের শত্রুদেরই প্রভাব, নিশ্চিহ্ন করতে হবে যদি পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে হয়। যারা আমাদের রাষ্ট্রের বুনিয়াদকে খর্ব করতে বদ্ধপরিকর তাদের কাছে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলার সময় এসছে।…যারা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে প্রাদেশিকতার ওকালতি রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা এবং কোন প্রকার প্রশ্রয় না দেয়া উচিত’। ‘ডনের’ এই সম্পাদকীয়টিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে একজন প্রাদেশিকতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয় যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের ধ্বনি তুলে সেই ধ্বনিকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।’