স্মার্ট কার্ড সঙ্কটে বিআরটিতে আটকে আছে ২০ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স’র আবেদন

144

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সারাদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্যক্রম থমকে গেছে। মূলত স্মার্টকার্ড সঙ্কটের কারণে লাইসেন্স দিতে পারছে না বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। অথচ প্রায় ২০ লাখ আবেদন এখন জমা আছে। আবেদনের ভারে কুঁজো হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা বদনামের মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে কার্ড না থাকা। অন্যদিকে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর লাইসেন্স রিনিউ করার আবেদন আছে দুই লক্ষাধিক। মাসের পর মাস যাচ্ছে কিন্তু লাইসেন্স মিলছে না। আবেদনের পর কার্ড কিংবা পরীক্ষার জন্য সময় দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত! ফলে বেড়েছে গ্রাহক ভোগান্তি। শীঘ্রই সঙ্কট সমাধানের কোন পথও দেখছেন না সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। যদিও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলছেন, সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা চলছে। সব মিলিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে বিআরটিএ এখন মহা অশান্তির কারণ। রাজধানীর আশপাশের দুটি বিআরটিএ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুব বেশি তদবির না থাকলে তারা এখন ড্রাইভিং লাইসেন্স করার আবেদন জমা নিচ্ছেন না। জমা নিলেও পরবর্তী প্রক্রিয়া বেশি দূর এগোচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইকুরিয়া বিআরটিএ কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আবেদন জমা নিয়ে কি লাভ। জমা নেয়া মানেই লোকজন বার বার জানতে চান কবে লাইসেন্স দেয়া হবে। কার্ড সরবরাহ বাড়লে সবকিছু স্বাভাবিক হবে।
ভুক্তভোগী আনোয়ার, জামাল, আশরাফসহ অনেকেই জানালেন, লাইসেন্স করার আবেদন জমা দেয়ার পর সব পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু ছবি তোলার জন্য কয়েক মাস ধরে সময় দিয়ে পেছানো হয়। কিন্তু ছবি তোলা হচ্ছে না। বার বার বলা হচ্ছে একটু সমস্যা আছে। তা মিটে গেলেই ছবি তোলা হবে। আরও একাধিক ব্যক্তি জানালেন, আবেদনের পর এক বছর সময় নেয়া হয়েছে পরীক্ষা বা কার্ডের জন্য।
সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স সঙ্কটেই ডুবতে যাচ্ছে সরকারী সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানটি। এই যখন পরিস্থিতি, তখন পরিবর্তন এসেছে সংস্থাটির প্রধান অর্থাৎ চেয়ারম্যান পদেও। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আগের অপরিকল্পিত পথচলার মাসুল দিতে হবে নতুন চেয়ারম্যানকেও।
সঙ্কট অন্তত দেড় বছর ধরে : লাইসেন্স প্রার্থীরা বলছেন, এক থেকে দেড় বছর ধরে শোনা যাচ্ছে কার্ড কম। লাইসেন্সের জন্য যোগ্য গড়ে প্রতিদিন এ রকম ৪শ’ ব্যক্তি বিআরটিএর মিরপুর অফিসে ছবি তোলার জন্য গিয়ে থাকেন। মিরপুর ছাড়াও ঢাকার উত্তরা, ইকুরিয়া অফিসেও তাদের ভিড় থাকে। ঢাকাসহ সারাদেশে বিআরটিএর ৫৭টি সার্কেল অফিস রয়েছে। সব অফিসেই সেবাপ্রার্থী সাধারণ মানুষের ভিড় ও ভোগান্তি দেখা গেছে লাইসেন্সের জন্য। কিন্তু সরবরাহ করা হচ্ছে মিরপুর অফিসের জন্য মাত্র ২০টি কার্ড। অন্য সার্কেল অফিসে এ সংখ্যা আরও কম। ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলা অফিসে ১০টি, অন্য বিভাগীয় শহরে পাঁচটি এবং কিছু অঞ্চলে দিনে তিনটি করে স্মার্টকার্ড দেয়া হচ্ছে।
বিআরটিএতে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ আবেদন জমা রয়েছে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য। অথচ দিনে গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে এক শ’রও কম। ডেলিভারির নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এক সপ্তাহে সারাদেশের ৫৭টি সার্কেল অফিস মিলিয়ে সর্বমোট যথাক্রমে ১১২, ১০৪, ১১১, ৫৯ ও ১০৮টি কার্ড সরবরাহ করেছে। নবেম্বর মাসে সারাদেশে কার্ড ডেলিভারির সংখ্যা ১ হাজার ৯৪২টি। ডিসেম্বরে এ্ই সংখ্যা আরও কম। অথচ দিনে ৪ হাজার কার্ড সরবরাহের কথা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। চাইলে আরও দুই হাজার কার্ড সরবরাহ করতে পারে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান।
সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিআরটিএর চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স চাহিদা অনুযায়ী দেয়া যাচ্ছে না; এটা ঠিক। দরপত্র প্রক্রিয়া চলছে। সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ ও তদারকিতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দূর করাই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।
বিআরটিএ সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খান বলেন, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর করার পর সব পক্ষ থেকেই যানবাহনের বৈধ কাগজপত্র করা ও ড্রাইভিং লাইসেন্স করার তাগিদ বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় যদি গ্রাহকরা ভোগান্তির শিকার হন তাহলে আইন বাস্তবায়নেও সমস্যা সৃষ্টি হবে।
সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, অনেকেই দিনের পর দিন ঘুরে লাইসেন্স সমস্যার সমাধান পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু কার্ড না থাকলে সমস্যার সমাধান মিলবে কিভাবে।
সম্প্রতি মতিঝিল বিআরটিসি ডিপোতে আয়োজিত এক শুনানিতে বিআরটিসি চালকরা যথাসময়ে লাইসেন্স ও কার্ড পাচ্ছেন না বলে মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলামের কাছে সরাসরি অভিযোগ করেন।
সময় মতো লাইসেন্স কার্ড সরবরাহে দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়ায় না যাওয়ায় তৈরি হয়েছে এ দুরবস্থা। দেরিতে টের পেয়ে বিআরটিএ অতিরিক্ত কার্ড ছাপানোর উদ্যোগ নিলেও তাতে লেজেগোবরে দশা সৃষ্টি হয়। ফলে থেমে যায় ওই প্রক্রিয়া। এখন লাইসেন্স কার্ড সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে দরপত্র প্রক্রিয়া অনুমোদনের উদ্যোগ নেয়ার সময় যখন, তখন তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে একের পর এক অভিযোগের তীরে এবং বিভিন্ন মহলের চাপের কারণে। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে চলছে তদবির, আসছে চাপ।
দরপত্র আহ্বান এবং কার্যাদেশ নিয়ে বিপাকে বিআরটিএ : একাধিক কর্মকর্তা জানান, সারাদেশে এখন ড্রাইভিং লাইসেন্সের ভয়াবহ সঙ্কট চলছে। লাইসেন্স মুদ্রণে দরপত্র আহ্বান এবং কার্যাদেশ প্রদান নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিআরটিএ। একদিকে দরদাতা বাছাই শেষে কার্যাদেশ প্রদানের প্রস্তাব পাঠানো নিয়ে আসছে নানা চাপ। অন্যদিকে গ্রাহকেরও চাপের মুখে পড়েছেন সংস্থার কর্মকর্তারা। দীর্ঘদিন ধরে স্মার্টকার্ড সঙ্কট শুনতে শুনতে গ্রাহকরা এখন অনেকটাই ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছেন। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জেগেছে, সমস্যার উত্তরণে আগে থেকে কেন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি? এর উত্তর নেই কারও কাছে।
কার্ডের খবর নেই
সঙ্কট আছে। এটি ধামাচাপা দেয়ার কিছু নেই। তাই বলে গ্রাহকরা কতদিন ঘুরবেন বিআরটিএ’র দ্বারে দ্বারে? রাজধানীর মিরপুর বিআরটিএ অফিসে গিয়ে দেখা যায়, পরীক্ষায় পাসের পর কার্ড সরবরাহের জন্য প্রথমে তিন মাসের সময় দেয়া হচ্ছে। এরপর নির্ধারিত তারিখে কার্ডের জন্য হাজির হলে আরও ৬ মাস পরের আরেকটি তারিখের কথা বলা হচ্ছে। সেই ৬ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও কার্ড প্রদান করা সম্ভব হবে না এবং ফের সময় নিয়ে নতুন আরেকটি তারিখ দেয়া লাগবে- এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে খোদ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কথায়। তাই সাধারণ আবেদনকারীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এদিকে শিক্ষানবিস লাইসেন্স পেতে আবেদন করেছেন, তাদের পরীক্ষা গ্রহণের তারিখ দেয়া হয়েছে এক বছরেরও পর।