ফের ফেসবুক গুজবে ভোলা রণক্ষেত্র ॥ গুলিতে মাদ্রাসা ছাত্র সহ ৪ জন নিহত

34

কাজিরবাজার ডেস্ক :
এক তরুণের ফেসবুক আইডি ‘হ্যাক করে অবমাননাকর’ বক্তব্য ছড়ানোর পর ‘মুসলিম তাওহিদী জনতা’র ব্যানারে সমাবেশ থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে কয়েকশ মানুষ। রবিবার বেলা পৌনে ১১টা থেকে বোরহানউদ্দিন উপজেলা সদরে দফায় দফায় সংঘর্ষে এক মাদ্রাসা ছাত্রসহ অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ১০ পুলিশ সদস্যসহ শতাধিক।
ভোলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার জানিয়েছেন, এই সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশের দিকে গুলিও ছোড়া হয়েছে। তাতে একজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বোরহান উদ্দিনে জরুরী ভিত্তিতে ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসক মাসুদ আলম সিদ্দিক জানিয়েছেন।
বোরহান উদ্দিন ঈদগাহ মাঠে ওই সমাবেশ ডাকা হয়েছিল বিপ্লব চন্দ শুভ নামের এক যুবকের বিচারের দাবিতে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ফেসবুক মেসেঞ্জারে নবী ও ইসলাম নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দিয়েছেন।
অথচ ওই যুবক শুক্রবারই ফেসবুক আইডি ‘হ্যাকড’ হওয়ার কথা জানিয়ে জিডি করতে গিয়েছিলেন বোরহান উদ্দিন থানায়। তদন্তে নেমে দুইজনকে আটক করার পর পুলিশ তার কথার সত্যতাও পেয়েছিল। সে অনুযায়ী শনিবারই স্থানীয় আলেমদের সঙ্গে কথা বলে রবিবারের বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচী প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করেছিল স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন।
আলেমরা তখন সম্মতি দিলেও রবিবার সকালে ঠিকই সমাবেশ শুরু করা হয় এবং সেখান থেকে হঠাৎ করেই পুলিশের ওপর আক্রমণ চালানো হয় বলে বোরহানউদ্দিন থানার ওসি এনামুল হক জানান।
তিনি বলেন, ‘বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ মসজিদের ইমাম মাওলানা জালাল উদ্দিন এবং বাজার মসজিদের ইমাম মাওলানা মিজানকে বিক্ষোভ সমাবেশ না করতে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। তারপরও শুরু করায় সাধারণ মানুষ আসার আগেই সেটা বন্ধ ঘোষণা করতে বলা হয়েছিল।
‘আমাদের অনুরোধে দুই ইমাম সকাল ১০টার দিকেই উপস্থিত লোকজনকে নিয়ে মোনাজাতের মাধ্যমে বিক্ষোভ মিছিলের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। কিন্তু ততক্ষণে বোরহানউদ্দিনের বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাজার হাজার লোক এসে ঈদগাহে জড়ো হয়েছে।
‘এক পর্যায়ে তারা দুই ইমামের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সেখানে থাকা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। পুলিশ তখন আত্মরক্ষার জন্য মসজিদের ইমামের কক্ষে আশ্রয় নেয়।’
ওসি বলেন, উত্তেজিত জনতা পুলিশকে লক্ষ করে বৃষ্টির মতো ঢিল ছুড়ছিল। এক পর্যায়ে পুলিশ আত্মরক্ষার জন্য শটগানের ফাঁকা গুলি ছোড়ে। কিন্তু তাতে তারা আরও উত্তেজিত হয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়।
সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয় এবং হতাহতের ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন, বোরহানউদ্দিন উপজেলার মাদ্রাসা ছাত্র মাহবুব পাটোয়ারি, উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কলেজছাত্র শাহিন, বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাহফুজ পাটোয়ারি এবং মনপুরা হাজিরহাট এলাকার মিজান।
বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক মোঃ শাহীন জানিয়েছেন, গুলিতে নিহত শাহীন ও মাহবুবের মৃতদেহ তার হাসপাতালে নেয়া হয়।
আর বাকি দু’জনকে মৃত অবস্থায় ভোলা সদর হাসপাতালে নেয়া হয় বলে জেলার সিভিল সার্জন রথীন্দ্রনাথ রায় জানান।
আহতদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ভোলা সদর হাসপাতাল ছাড়াও কয়েকজনকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
আর গুলিবিদ্ধ এক পুলিশ সদস্যকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে জানিয়ে ভোলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার বলেন, সমাবেশকারীদের ছোড়া গুলি ওই পুলিশ সদস্যের বুকে লাগে।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, শুক্রবার বিকেলে বিপ্লব চন্দ্র শুভ’র নিজের নাম ও ছবি সম্বলিত ফেসবুক আইডি থেকে ধর্ম নিয়ে কুরুচিপূর্ণ গালাগাল করে তার কয়েকজন ফেসবুক বন্ধুর কাছে মেসেজ করে। এক পর্যায় কয়েকটি আইডি থেকে মেসেজগুলোর স্ক্রিন শর্ট নিয়ে ফেসবুকে কয়েকজন প্রতিবাদ জানালে বিষয়টি সকলের নজরে আসে। এমনকি বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এ অবস্থায় সন্ধ্যার পর বিপ্লব চন্দ্র বোরহান উদ্দিন থানায় আইডি হ্যাক হয়েছে মর্মে জিডি করতে আসলে থানা পুলিশ বিষয়টি তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিপ্লব চন্দ্রকে তাদের হেফাজতে রাখেন। বিপ্লব চন্দ্র শুভ বোরহানউদ্দিন উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের চন্দ্র মোহন বৈদ্দের ছেলে। সে ডিগ্রি পাস করেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে বোরহানউদ্দিনের কুঞ্জেরহাট বাজারে সর্বস্তরের মুসলিম তাওহিদী জনতার ব্যানারে মানববন্ধন করা হয়েছে এবং থানার সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছে তাওহিদী জনতা। এ সময় তারা ঘটনার সত্যতা যাচাই করে বিপ্লব চন্দ্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।
এদিকে বোরহানউদ্দিন থানার ওসি মোঃ এনামুল হক বলেন, বিপ্লব চন্দ্র শুভ নিজের ইচ্ছায় এসেছে তার ফেসবুক হ্যাক হয়েছে বলে জিডি করতে। সে জানায় তার কাছ থেকে একটি মোবাইল থেকেও চাঁদা চাওয়া হয়েছে। ট্র্যাকিং করে শরিফ ওরফে শাকিলকে পটুয়াখালীর কলাপাড়া থেকে আটক করে বোরহানউদ্দিন এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাকে ছাড়াও শাকিল নামে আরও ১ যুবককে আটক করা হয়। কিন্তু বোরহানউদ্দিন উপজেলার তাওহিদী জনতার ব্যানারে মুসল্লিরা রবিবার বেলা ১১টায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাওহিদী জনতার ব্যানারে মুসল্লিরা নবী ও আল্লাহকে কটূক্তিকারী বিপ্লবের ফাঁসির দাবিতে ঈদগাহ মাদ্রাসার মাঠে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। সমাবেশে ভোলা পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার উপস্থিত ছিলেন। বেলা পৌনে ১১টার দিকে হঠাৎ করে সমাবেশ স্থল থেকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে পুলিশকে ধাওয়া করলে এসপি সহ পুলিশ সদস্যরা মসজিদ মাদ্রাসার একটি কক্ষে আশ্রয় নেয়। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ করলে সংর্ঘষ ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে পুলিশের এসপি যে রুমে আশ্রয় নেয় সেই রুমেও হামলা চালায়। এ সময় বিক্ষিপ্তভাবে সংর্ঘষ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ চলে। এ সময় পুলিশ চারদিকে ব্যাপক গুলি ছুড়ে বলে অভিযোগ করে স্থানীয়রা। পুলিশের গুলিতে মাহফুজ পাটওয়ারী, মিজান, শাহিন, মাহবুব নামে ৪ জন মুসল্লি নিহত হয়। এতে ২০ পুলিশসহ ২ শতাধিক লোক আহত হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ভোলা চরফ্যাসন সড়ক অবরোধ করা হয়। এতে করে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভোলা সদরেও বিক্ষোভ করা হয়। খবর সংগ্রহ করতে গেলে বাংলা টিভির সাংবাদিক জুয়েল সাহা ও জিটিভির ক্যামেরাপার্সন জয় দের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ব্যাপক মারধর করা হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, বোরহানউদ্দিনের ঈদগাহ মাঠের সামনে রাস্তায় ছোফ ছোফ রক্তের দাগ। সমাবেশ স্থলের মঞ্চ ভাংচুর করা। বোরহানউদ্দিন হাসপাতালে স্বজনদের আহাজারি। হাসপতালের কক্ষে পড়ে রয়েছে ২টি লাশ। অসংখ্য রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ভোলা সদর হাসপাতাল ও বরিশালে বহু আহত রোগী গুরুতর অবস্থায় পাঠানো হয়েছে। এদিকে ভোলা সদর হাসপাতালে নেয়ার পর আহত ২ জনকে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করা হয়। বোরহানউদ্দিন হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ আবুল কালাম আযাদ জানান, প্রায় ২ রোগীকে তারা চিকিৎসা দিয়েছে। নিহত হয়েছে ৪ জন। এদিকে ভাওয়াল বাড়ি রাধা গৌর নিতাই মন্দিরে উত্তেজিত জনতা ভাংচুর করেছে।
এদিকে বরিশাল ডিআইজি শফিকুর ইসলাম রবিবার সন্ধ্যায় বোরহানউদ্দিন থানায় এক প্রেস ব্রিফিং এ বলেন, বহিরাগতরা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে একটি পক্ষ ঘটনা ঘটিয়েছে। সমাবেশ শেষ পর্যায়ে হঠাৎ হামলা করা হয়। মসজিদে অবমাননা করা হয়। পুলিশের এক সদস্যকে গুলি করা হয়। তাকে সিএমএইচ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। তবে কার গুলিতে আহত করা হয়েছে তা নিশ্চিত বলতে পারেননি। তদন্ত করে বলা যাবে।
বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার ইয়ামিন চৌধুরী বলেন, এ ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ভোলা পুলিশ সুপার বলেন, সমাবেশের শেষদিকে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ নিরাপত্তার সঙ্গে ফাকা গুলি ছুড়ে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে পুলিশ আটক করেননি। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।
গুলিবিদ্ধ ২৮ জন শেবাচিমে ভর্তি : স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল থেকে জানান, ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে স্থানীয়দের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় গুরুতর আহত ২৮ জনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছেন। রবিবার দুপুর একটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত উন্নত চিকিৎসার জন্য আহতদের শেবাচিমে ভর্তি করা হয়।
শেবাচিমের জরুরী বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক আবুল হাসানাত রাসেল জানান, ভর্তিকৃতরা সবাই গুলি ও গুলির পিনবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। আহতরা হলো-বোরহানউদ্দিনের মিজানুর রহমান (৩০), ইউনুস আলী (৬০), নান্টু (৪০), মাকসুদুর রহমান (১৮), তানভীর হোসেন (৩০), ওয়ালিউল্লাহ (২৪), সিদ্দিকুর রহমান (২৮), আবু তাহের (৩০), শামীম (১৮), সোহরাব হোসেন (৩০), আলামিন (১৮), জামাল উদ্দিন (২৫), আবুল কালাম (৩৮), কবির হোসেন (৩৫), আলাউদ্দিন (৪২), সোহেল (২৬), হান্নান (৪৫), রিয়াজ (২৯), ইমাম হাসান (২৬), নুরুল ইসলাম (৩৫), রকিব (১২), মনির হোসেন (১৭), হাসিব রহমান (১৪), তাজুল ইসলাম (৫৫), মুন্না (১৩), সুজন (৩৫), রাকিব হোসেন (১৫) ও অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি (৪০)।