ডিসিদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী ॥ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একান্ত হয়ে কাজ করুন

32

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে চলমান উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে কাজের গতি বাড়ানো এবং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সরকারী সব সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সমন্বিতভাবে কাজ করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারী সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষ যাতে কোনভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হন সেদিকেও জেলার অধিকর্তাদের সতর্ক করে দেন তিনি।
সুশাসন, নারী ও শিশু নির্যাতন, সন্ত্রাস-জঙ্গি, মাদক, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি নির্মূল, খাদ্যে ভেজালসহ বিভিন্ন বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য উন্নয়নের গতিটা অব্যাহত রাখাটা জরুরী। আর এটা মাথায় রেখেই আপনাদের (জেলা প্রশাসক) কাজ করে যেতে হবে। আপনারা আপনাদের যে মেধা ও মনন দিয়ে এই দেশটাকে গড়ে তুলবেন। আর সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে যেন কর্মক্ষেত্রে আপনাদের দক্ষতার পরিচয় রাখতে পারেন সেটাই আমি চাই। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে এবং জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলবই।
রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার তেজগাঁওস্থ কার্যালয়ে পাঁচ দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলন-২০১৯-এর উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশ্যে করে বলেন, সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতিসহ নানা ধরনের যে অসামাজিক কার্যক্রম সেগুলো বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতির ক্ষেত্রে স্পষ্ট কথাটা হচ্ছে যে. ঘুষ যে নেবে সে শুধু অপরাধী না, যে দেবে সেও সমানভাবে অপরাধী। বরং যে দেবে সেই বেশি অপরাধী। এই কথাটা মাথায় রেখেই কিন্তু আমরা কাজ করলে তাহলেই আমরা এর হাত থেকে মুক্ত করতে পারব।
জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস দমন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনসম্পৃক্ততার সৃষ্টির মাধ্যমে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করা হচ্ছে- এটাই হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা। এটাকে অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। কিন্তু তার মানে এই না যে, এটা শেষ হয়ে গিয়েছে। কাজেই সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থাসহ সবাইকে সক্রিয় রেখে সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে এবং সমাজের সবাইকে যুক্ত করে এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলে প্রতিরোধ করতে হবে।
ডিসি সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম, শেরপুর জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন এবং খুলনার বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোঃ নজিবুর রহমান ও এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- নিয়ে একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যগণ, সিনিয়র সচিব এবং সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ, অংশগ্রহণকারী বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এ বছরের ডিসি সম্মেলনে মোট ২৯টি অধিবেশন হবে এবং সম্মেলনে ৩৩৩টি প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। আইনশৃঙ্খলা, ভূমি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সমূহের কার্যক্রম জোরদার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, দারিদ্র্য দূরীকরণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে। জেলা প্রশাসকগণ সম্মেলন চলাকালে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সঙ্গেও সাক্ষাত করবেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের উদ্দেশ্যে করে আরও বলেন, তার সরকার একটি লক্ষ্য নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে। আপনাদের (ডিসি) চাকরি তো দীর্ঘকালীন, আর আমাদের চাকরি স্বল্প মেয়াদের। পাঁচ বছরের জন্য আমরা নির্বাচিত হয়েছি। কাজেই এই পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের দেশটাকে একটা জায়গায় নিয়ে আসতে চাই এবং সেই লক্ষ্য নিয়েই আমর বাজেট দিয়েছি, পরিকল্পনা নিয়েছি বা নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছি। আর সেই লক্ষ্যটা হলো বাংলাদেশ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হবে, যোগ করেন তিনি।
২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর আগেই দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে চান উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ইতোমধ্যে আমাদের ২১ ভাগ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে এবং আমি মনে করি, আমরা যদি আরেক নেই- আমাদের হাতে এখনও যে সময়টা রয়েছে তাতে ২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ২-৩ ভাগ কমাতে পারব। আপনারা জানেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্র্যের হার ১৮ ভাগ। আমরা তার থেকে অন্তত এক ভাগ বেশি কমাতে চাই। আপনাদের প্রচেষ্টা থাকলে অবশ্যই আমরা পারব।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্য পূরণে পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর যথাযথ বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশ্যে বলেন, যারা আমাদেরকে একদিন বলেছিল, বাংলাদেশ ‘বটমলেস বাস্কেট’ হবে। তাদের দেখাতে চাই দারিদ্র্যের হার কমিয়ে এনেছি। ২০২৪ সালের মধ্যে এই হারকে আরও কমাব। আর ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ এই দক্ষিণ এশিয়ায়। এই দেশের মানুষ যেন মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে চলতে পারে- সে ব্যবস্থাটাই তার সরকার করতে চায়। আর খালি হাততালি না, আপনাদের ওয়াদা করতে হবে, আপনারা এটা করবেন। উপস্থিত জেলা প্রশাসক ও কমিশননারগণ এ সময় হাত তুলে এতে সম্মতি জানান।
তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করার জন্য ডিসিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ঠেকাতে পদক্ষেপ নিতে হবে। দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এই হাসপাতালগুলোতে আমাদের সমস্যা হয় ডাক্তার থাকে না, সার্জন থাকে না, এ্যানেসথেসিষ্ট থাকে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিসিরা স্বপ্রণোদিত হয়ে নানা সামাজিক উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। যার সুফল সাধারণ জনগণ পেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ভিক্ষুকমুক্ত করার জন্য খুলনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রথমে উদ্যোগ নেয়া হয়। পরে এর সঙ্গে তিনিও সম্পৃক্ত হন। তবে, যারা পেশাদার ভিক্ষুক, তাদের এই পেশা থেকে সরানো কষ্টকর। অন্যদিকে নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় মানুষ নতুন করে গৃহহারা ও নিঃস্ব হচ্ছে। তিনি বলেন, যখনই এমন হবে তখনই তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। কেউ ভিক্ষা করতে পারবে না। আর সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের কর্মসূচীর তালিকা প্রণয়নকালে প্রকৃত দুঃস্থরাই যেন সহায়তা পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের জনসংখ্যা বেশি হলেও তা বোঝা নয়। জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা গেলে তারাই হবে উন্নয়নের মূল শক্তি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা প্রশাসকদের করণীয় হিসেবে ৩১ দফা নির্দেশনা প্রদান করেছেন।