সংসদে যোগ দেয়ায় বিএনপির এমপিদের ধন্যবাদ জানালেন প্রধানমন্ত্রী ॥ সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে

47
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে আসন্ন বিশ্বকাপে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী এ সময় তাদেরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দেয়ার জন্য বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে রূখে দাঁড়াতে হবে। সবাইকে সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে হবে। কোথাও কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখলে সবাই (দেশবাসী) যেন আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দেয়। আমরা শান্তি চাই, সমৃদ্ধি চাই। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে অগ্রযাত্রা, সেই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ ক্ষুধামুক্ত দেশ হয়েছে, দারিদ্র্যমুক্তও হবে।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে মঙ্গলবার রাতে একাদশ জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী পুঁজিবাজার প্রসঙ্গে বলেন, পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছি। তবে পুঁজিবাজার নিয়ে যদি কেউ কোন ধরনের গেম খেলার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, ব্যবস্থা নেব। এটা নিয়ে খুব বেশি শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জার্সি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবুজ আমাদের জাতীয় পতাকার রং। এই সবুজের মধ্যে লাল রং দিয়ে বাংলাদেশ লেখা হয়েছিল। আইসিসি আপত্তির কারণে তা পরিবর্তন করে সাদা লেখা হয়েছে। এটাতে পাকিস্তানের জার্সির সঙ্গে মেলানোর কিছু নেই, ঠিক হবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করে গেছেন বলেই আমরা সংসদ পেয়েছি, সংসদ সদস্য হতে পেরেছি। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দেয়ায় আমাদের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সংগ্রাম করেছে গেছেন, তাঁর স্বপ্ন পূরণই আমাদের লক্ষ্য। সব ব্যথা ভুলে দেশের মানুষের কল্যাণেই কাজ করে যাচ্ছি। ধারাবাহিকভাবে আমরা ক্ষমতায় থাকতে পেরেছি বলেই বাংলাদেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। দেশ আজ সব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সংসদ নেতা বলেন, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা শান্তি চাই, সমৃদ্ধি চাই। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে কিছু মানুষকে ব্যবহার করা হয় মানুষ হত্যার জন্য। তাদের দিয়ে মানুষ হত্যা করানো হয়, বলা হয় তারা বেহেস্তে যেতে পারবে। নিরীহ মানুষকে হত্যা করে বেহেস্তে যাবে, এটা কীভাবে চিন্তা করে? মানুষ হত্যা তো মহাপাপ। যারা নিরীহ মানুষকে হত্যা করে তারা কীভাবে বেহেস্তে যাবে? যারা এদের ব্যবহার করে ধর্মান্ধ করছে, মানুষকে হত্যা করাচ্ছে, যারা শিক্ষাটা দিচ্ছে তারা আগে কেন বেহেস্তে যাচ্ছে না?
তিনি বলেন, যারা এই শিক্ষাটা দিয়ে ধর্মান্ধ করছে, যারা বোমা ও গুলি মেরে হত্যাকা- ঘটাতে ব্যবহার করছে তারা ভাবছে তারা বেহেস্তের নাকি খুব কাছে পৌঁছে যাচ্ছে! যারা এই শিক্ষাটা দিচ্ছে তারা আগে কেন বেহেস্তে চলে যায় না, আর বেহেস্তের পথ অনুসরণ করে না? যারা শিক্ষা দিচ্ছে তারা তো নিজেরা মরছে না। ব্যবহার করা হচ্ছে কিছু যুব সমাজকে। অবাক লাগে কিছু সম্পদশালী ধনী পরিবার উচ্চ শিক্ষিত পরিবারও ধর্মান্ধের পথে যাচ্ছে। আমি জানি না যারা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়, তারা কীভাবে এভাবে ধর্মান্ধ হয়ে যায়? আমরা চাই এই ধর্মান্ধতা থেকে মানুষ মুক্তি পাক। আর যারা শিক্ষা দিচ্ছে তাদের বলব আগে আপনারা যান, বেহেস্তে গেলেন কি না সেটা আগে জানান, তারপর আমরা যাব। সেটা অন্তত বলা উচিত।
দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশবাসীকে আহ্বান জানাব, কোথাও কোন অস্বাভাবিক অবস্থা দেখলে যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দেয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারীরা বাংলাদেশ উন্নয়ন হোক তা কখনও চায়নি। বাংলাদেশ ভিক্ষুকের জাতিতে থাকুক, ক্ষুধার্ত মানুষকে দেখিয়ে বিদেশ থেকে সাহায্য এনে লুটেপুটে খাওয়া, এটাই ছিল তাদের নীতি। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখনই ভিক্ষা বা হাত পেতে না নয়, নিজেদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলব। ভিক্ষা নেব না। বঙ্গবন্ধুই বলেছেন, ভিক্ষুকের জাতির কোন সম্মান থাকে না। দেশকে যে উন্নতি করা যায় তা আমরা প্রমাণ করেছি।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, হত্যা, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, সৃষ্টি হয়, অবাধে লুটপাট করেছে তারা। তাদের হাত থেকে বিচারকরাও রেহাই পায়নি। তাদের অপকর্মের কারণে ওয়ান-লেভেনের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ। ধান উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ। মিঠা পানির মাছেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। ব্যাপক গবেষণার ফলেই আমরা উৎপাদন বাড়াতে পেরেছি। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করেছি।
সংসদ নেতা আরও বলেন, দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। শহর ভিত্তিক নয়, গ্রামের অর্থনীতিকে আমরা শক্তিশালী করছি। গ্রামীণ অর্থনীতিকে আমরা শক্তিশালী করে যাচ্ছি। গ্রামের মানুষ যেন নগরের সেবা পান, সেই ব্যবস্থাও করছি। দেশের সন্তানদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে বিনামূল্যে বই দিচ্ছি, বৃত্তি দিচ্ছি। বাংলাদেশ যেন বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা মহাকাশ জয় করেছি, নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছি। সীমান্ত সমস্যা, ছিটমহল সমস্যা, সমুদ্রসীমা সমস্যা আমরা সমাধান করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষের জীবনমান আমরা উন্নত করতে সক্ষম হয়েছি। গ্রাম-বাংলায় বসতবাড়ি আর কুঁড়েঘর পাওয়া যায় না, অন্তত সবার টিনের ঘর আছে। সকল সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় কারা গৃহহারা, কাদের জমি নেই, কারা নিঃস্ব তা খুঁজে বের করুন। আমরা সমস্ত অর্থ ব্যয় করবো গৃহহীনদের ঘর তৈরি করে দিতে। দেশের কোন মানুষ আর গৃহহীন থাকবে না। একটি মানুষও ভূমিহীন থাকবে না, বিনা পয়সায় জমি দিয়ে যাব। বাংলাদেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছি। জেলা-উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগ নেবে, তারা যে অর্থ সংগ্রহ করবে, তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে প্রয়োজনে কিছু দেয়া হবে। অনেক বিত্তশালী ও এমপিরাও নিজ নিজ এলাকায় যেসব স্কুলে ল্যাপটপ নেই সেখানে কিনে দিতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারাদেশে আমরা সামাজিক নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করে যাচ্ছি। এর সুফল দেশের মানুষ পাচ্ছে। প্রতিবন্ধী-অটিস্টিকদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি, যাতে তারা অবহেলার শিকার না হয়। দেশের প্রতিটি মানুষের কল্যাণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে পানির জন্য হাহাকার ছিল। আমরা সেই সমস্যার সমাধান করেছি। কিছু জায়গায় পানির সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যেখানে পানি জমা হয়, সেই ট্যাঙ্ক নিয়মিত পরিষ্কার করা হবে। পানি নিয়ে শরবত নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ট্যাঙ্কি পরিষ্কার কি না, তা আগে দেখুন। তবে ওয়াসা এ ক্ষেত্রে দায়ী থাকে, তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আগে দেশে প্রচুর তালগাছ ছিল, বজ্রপাত টেনে নিত। কিন্তু এখন তালগাছের অনেক অভাব। তিনি বলেন, বন্ধ পাটকল আমরা চালু করেছি। ইতোমধ্যে আমরা ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছি, তারপরও শ্রমিকরা বেতন পায় না। মিল চালাবে, শ্রমিকদের সরকারকে প্রতিবার বেতন দিতে হবে? মিলগুলোকে কীভাবে লাভজনক করা যায়, ব্যবস্থাপনা টিক আছে কিনা, সেখানে আগে হাত দিতে হবে। অনেক নিজেদের সম্পদ রক্ষা না করে, লুটপাট করে। এই লুটপাট হচ্ছে কি না তা আমরা ধরব।
পুঁজিবাজার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে গেলে লাভও হবে, লোকসানও হতে পারে। এটা জেনেই তো সবাই বিনিয়োগ করেন। সরকার থেকে যা যা করার তা করে যাচ্ছি। কেউ যদি কোনরকম গেম খেলতে চায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এবং হবে। পুঁজিবাজার তো অনেকটা জুয়া খেলার মতো। কোন কোম্পানি কিনলে লাভ হবে সেটা বিবেচনা বিনিয়োগকারীদেরই করতে হবে। তবে পুঁজিবাজার নিয়ে বেশি চিন্তার কোন কারণ নেই।
তিনি বলেন, দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছি। দেশের যে কোন মানুষ কাজ করে খেতে পারে, সেজন্য বেসরকারী খাতকে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। তবে সব মানুষকে তো সরকারী চাকরি দেয়া যায় না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদেশে যত মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, অতীতে কখনও হয়নি। নিজ সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাবার হোটেলে খেলে আমরা সন্তানরা মানুষ হয়নি। কাজ করে, স্টুডেন্ট লোন নিয়ে নিজেদের পড়াশোনা চালিয়েছে। এখনও পার্টটাইম কাজ করছে। সবাই নিজেরা খেটে খেয়েছে। পড়াশোনা করা অবস্থায় চাকরি করেছে। তাই তাদের সঙ্গে অন্যদের তুলনা চলে না।
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবির জবাবে তিনি বলেন, ৩৫ বছরে যদি কেউ চাকরিতে প্রবেশ করে, ট্রেনিং নিতে নিতে তাদের বয়স ৩৮ বছর হয়ে যাবে। ৩৮ বছরে যে চাকরিতে প্রবেশ করবে তাকে ২২ বছরের মতো অবসর নিতে হবে, তারা তো পূর্ণাঙ্গ পেনশন পাবে না। তাই এমন দাবি তো বাস্তবসম্মত নয়। ২১-২৫ বয়সীদের মধ্যে মেধা, মনন ও দক্ষতা বেশি থাকে। বয়সসীমা বাড়ানো হলে নতুন চাকরি দেয়া যাবে না। কেউ রিটায়ারমেন্টে যাবে না, পদ খালি হবে না, তাই চাকরি দেয়াও যাবে না। তখন চাকরি দেবেন কীভাবে? শুধু দাবি তুললেই হবে না, যারা আন্দোলন করেন তাদের এসব বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
ক্রীকেট দলের জার্সি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবুজ আমাদের পতাকার রং। কোন আন্তর্জাতিক ইভেন্ট হলে তখন একটা ড্রেস কোড আয়োজক সংস্থাই করে দেয়। জার্সির মধ্যে থাকা লাল রঙের অংশের মধ্যে বাংলাদেশ লেখা হয়েছিল। এতে আইসিসি আপত্তি জানিয়ে বলেছে, লালের মধ্যে দেশের নাম লেখা যাবে না। আইসিসির আপত্তি আমাদের মানতেই হবে। সেজন্য সেখানে সাদা দিয়ে লেখা হয়েছে। তাই জার্সি পাকিস্তানের মতো হয়ে গেছে, এটা কিন্তু ঠিক নয়। ফুটবল খেলায় ছেলেরা ভাল করতে না পারলেও মেয়েরা কিন্তু খুব ভাল খেলছে।