৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর আত্মপ্রত্যয়ের স্বরূপ

98

প্রফেসর আবদুল খালেক

বিশ্বের যাঁরা মহান কবি, বরেণ্য শিল্পী, প্রখ্যাত সাহিত্যিক, যাঁরা খ্যাতিমান রাষ্ট্রনায়ক, তাঁদের সকলের মধ্যেই কম-বেশি আত্মপ্রত্যয় তথা আমিত্ববোধের প্রকাশ দৃশ্যমান। আমিত্ববোধের মধ্যে বিরাজ করে অহংবোধ। অহংবোধকে আমরা ইতিবাচক বলেই বিবেচনা করতে পারি, তবে সেই অহংবোধ যদি অহঙ্কারে রূপান্তরিত হয়, বিপদ সেখানে। যে কবি নিজের ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতিকে বিশ্বের সকল মানুষের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে মিলিয়ে একাকার করে দিতে পারেন, তিনিই হয়ে ওঠেন বিশ্বকবি। অনুরূপভাবে যে রাজনৈতিক নেতা নিজের ব্যক্তিগত জীবনা দর্শনকে দেশের সকল মানুষের জীবন দর্শনে রূপান্তরিত করতে সমর্থ হন, তিনিই শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। একজন বড় মাপের কবির ক্ষেত্রে আত্মপ্রত্যয়, আমিত্ব ,ব্যক্তিত্ব এবং কবিত্ব যেমন একে অপরের পরিপূরক; একইভাবে মহান কোন রাষ্ট্রনায়কের ক্ষেত্রেও আত্মপ্রত্যয়, আমিত্ব, ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্বকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার তেমন সুযোগ নেই। আমিত্বকে তথা নিজেকে যখন কেউ সকল মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে বা মিলিয়ে দিতে পারেন, তখন তিনি মহৎ মানুষ বা মহামানবের সম্মানে ভূষিত হন। প্রসঙ্গক্রমে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ দুই কবি যথা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম এখানে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করছি।
রবীন্দ্রনাথের আমিত্বের মধ্যে একটি বিনয়ী ভাব আছে। রবীন্দ্রনাথের আমিত্বের প্রকাশ তাঁর কবিতায় এবং গানে কেমনভাবে এসেছে এখানে দু’একটি উদাহরণ তুলে ধরছি।
ক. আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার/চরণধুলোর তলে।
খ. বিপদে মোরে রক্ষা করো/এ নহে মোর প্রার্থনা/বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
গ. আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি।
রবীন্দ্রনাথের আমিত্বের মধ্যেই বিরাজ করছে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠত্ব। নিজের চিন্তা-ভাবনা, নিজের আবেগ-অনুভূতিকে অত্যন্ত শৈল্পিক উপায়ে বিশ্বের সকল মানুষের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পেরেছেন বলেই তিনি বিশ্বকবি। আমিত্বকে যাঁরা নেতিবাচক দৃষ্টিতে বিচার করতে আগ্রহী, আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মূল্যায়নে তাঁরা কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হবেন। গানটির শুরুই হয়েছে আমিত্ব দিয়ে, যেমন- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’
এবার কবি নজরুল ইসলামের কবিতায় আমিত্বের প্রকাশ যেভাবে ঘটেছে সে দিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নজরুলের শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে স্বীকৃত। বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল ইসলাম গভীর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে উল্লেখ করেছেন-
ক. আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস/আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।
খ. আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন/আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।
গ. আমি চির বিদ্রোহী বীর/বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা- চির উন্নত শির।
নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় আমিত্ব চেতনার যে প্রকাশ ঘটেছে, তাকে নেতিবাচক বলে অভিহিত করার কোন সুযোগ নেই। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের কবি, নজরুলকে আমরা বলে থাকি জাতীয় কবি। তাঁদের যে সমস্ত কবিতায় আমিত্বের প্রকাশ ঘটেছে, সে কবিতাগুলোই কালজয়ী হয়ে উঠেছে। এবার বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমিত্ব তথা আত্মপ্রত্যয় বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর আমিত্ববোধের স্বরূপ বুঝতে হলে তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ পাঠ করা অত্যন্ত জরুরী। বঙ্গবন্ধুর জন্ম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বদানের গুণাবলী ছোটবেলা থেকেই লক্ষ্যণীয়। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন- ‘আমি ভীষণ একগুঁয়ে ছিলাম। আমার একটা দল ছিল। কেউ কিছু বললে আর রক্ষা ছিল না। মারপিট করতাম। আমার দলের ছেলেদের কেউ কিছু বললে এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। আমার আব্বা মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১০)।
১৯৩৮ সালের একটি ঘটনা। শেখ মুজিবের বয়স তখন ১৮ বছর। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। বাংলার এই দুই নেতা একসঙ্গে গোপালগঞ্জে এসেছিলেন একটি এক্সিবিশন উদ্বোধন করতে। হোসেন শহীদ সোহাওয়ার্দীর সঙ্গে শেখ মুজিবের প্রথম সাক্ষাত এবং কথাবার্তার পরই সোহাওয়ার্দী সাহেব উপলব্ধি করতে পারেন শেখ মুজিবের মধ্যে নেতৃত্বের অসাধারণ গুণাবলী আছে। সোহাওয়ার্দী সাহেব কলকাতায় গিয়েই শেখ মুজিবকে একটি চিঠি লেখেন, কলকাতায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন।
১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন, থাকতেন বেকার হোস্টেলে। এই সময় জনাব হোসেন শহীদ সোহাওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী শেখ মুজিবকে রাজনীতির পাঠ দিতে থাকেন এবং শেখ মুজিবও গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে সে পাঠ গ্রহণ করতে শুরু করেন। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিব হোসেন শহীদ সোহাওয়ার্দীর নির্দেশ মতো কাজ করতে গিয়ে রাজনীতিতে অনেক পরিপক্বতা লাভ করেন। সে সময় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে নানা রকম বিভাজন ছিল। সেই বিভাজন ছাত্রদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদের মধ্যে দুটো দল হয়ে যায়। এক পর্যায়ে ছাত্রদের নিয়ে দলাদলি মিটমাট করার জন্য সোহাওয়ার্দী সাহেব উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই সময় কোন একটি বিষয় নিয়ে সোহাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে শেখ মুজিবের মতপার্থক্য দেখা দেয় এবং কথা কাটাকাটি হয়। শেখ মুজিব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন- যে ছাত্রটিকে সোহাওয়ার্দী সাহেব সমর্থন করছেন তিনি তাকে গ্রহণ করবেন না। এ কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে সোহাওয়ার্দী সাহেব ইংরেজীতে শেখ মুজিবকে বলে ফেলেন ‘ Who are you? You are nobody.শেখ মুজিব অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিয়েছিলেন- If I am nobody, then why you have invited me, you have no right to insult me. I will prove that I am somebody. Thank you sir, I will never come to you again.’ এ কথা বলে চিৎকার করতে করতে বৈঠক ছেড়ে বের হয়ে এলাম (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : পৃষ্ঠা-২৯)। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারেননি শেখ মুজিব। সোহাওয়ার্দী সাহেব দ্রুত নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং শেখ মুজিবকে পথ থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত সোহাওয়ার্দী সাহেবের আহ্বানে ফিরে আসেন। সোহাওয়ার্দী সাহেব শেখ মুজিবের দাবি মেনে নিয়ে বলেন- ‘যাও তোমরা ইলেকশন কর, দেখ, নিজেদের মধ্যে গোলমাল করো না।’ শেখ মুজিবের আত্মজীবনীতে উল্লেখ আছে- ‘সোহাওয়ার্দী সাহেব আমাকে আদর করে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন- বললেন, আমি তো আর কাউকেই এ কথা বলি নাই, তোমাকে বেশি আদর ও স্নেহ করি বলে তোমাকেই বলেছি’ (পৃ. ২৯)। এভাবেই শেখ মুজিবের আমিত্বের বিজয় শুরু হয়। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছাড়া এই আমিত্ববোধের প্রকাশ ঘটতে পারে না। সোহাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে যখন শেখ মুজিবের বিতর্ক হয়, তখন শেখ মুজিবের বয়স মাত্র ২৪ বছর। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে যে তরুণ বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারে- ‘ I will prove that I am somebody.’ উপলব্ধি করা যায় কি প্রচ- আত্মপ্রত্যয়, আমিত্ব চেতনা, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্বের গুণাবলী তরুণ শেখ মুজিবের মধ্যে দানা বেঁধে উঠতে শুরু করেছিল।
শেখ মুজিব তাঁর জীবনকালে রাজনৈতিক কারণে কতবার কারাবন্দী হয়েছিলেন, তা আজ গবেষণার বিষয়। জেলের ভয়ে কখনও তিনি পালিয়ে বেড়াননি। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা পর্যন্ত অধিকাংশ সময় শেখ মুজিবকে জেলের অভ্যন্তরে কাটাতে হয়েছে। শেখ মুজিবের সমালোচকরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে তিনি না পালিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু পালানোর ব্যাপারটি যে শেখ মুজিবের চরিত্রেই ছিল না, সে খবর তাঁরা রাখেন না। বিপদে না পালানো তাঁর জীবন দর্শন। আর এই জীবন দর্শনের উন্মেষ ঘটে তাঁর ছোটবেলা থেকেই। প্রসঙ্গক্রমে একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। শেখ মুজিবের বয়স যখন ১৮ বছর, সেই সময় শেখ মুজিবের মালেক নামের এক বন্ধু হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়। বন্ধুকে উদ্ধার করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মারপিটের ঘটনা ঘটে যায়। বিষয়টি নিয়ে প্রতিপক্ষ থানায় এজাহার দায়ের করে। এজাহারে আসামি হিসেবে যাদের নাম থাকে, তাদের গ্রেফতারের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। শেখ মুজিবকে জানানো হয়, গ্রেফতারের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে কিছু সময়ের জন্য বাড়ি থেকে সরে যেতে হবে। শেখ মুজিবের ভাষায়- ‘আমার ফুফাত ভাই, মাদারীপুর বাড়ি। আব্বার কাছে থেকেই লেখাপড়া করত, সে আমাকে বলে, ‘মিয়া ভাই, পাশের বাসায় একটু সরে যাও না।’ আমি বললাম, ‘যাবো না, আমি পালাবো না, লোকে বলবে, আমি ভয় পেয়েছি’ অসমাপ্ত আত্মজীবনী : (পৃ.১২)। ১৮ বছরের মুজিব গ্রেফতারের ভয়ে বাড়ি থেকে সেদিন পালিয়ে যেতে যেমন রাজি হন নি, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার পূর্বমুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা যখন তাঁকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তখনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উত্তর ছিল- ‘আমি পালাবো না।’ শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য যখন তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়ি ঘিরে ফেলা হয় এবং প্রচ-ভাবে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়, তখন সামরিক বাহিনীর জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘আমি পালাবো না।’ মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তিনি পালাননি, বরং অসীম সাহসিকতার সঙ্গে তিনি ঘাতকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। লক্ষ্যণীয়, ঘাতকের গুলি তাঁর বুকে লেগেছিল, পেছনে নয়। মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তাঁর নীতিতে অটল থেকেছেন- ‘আমি পালাবো না।’
বঙ্গবন্ধুর আমিত্ব তথা অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে একটি বিশাল গ্রন্থ রচিত হতে পারে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তারিখে রমনার রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ বঙ্গবন্ধু প্রদান করেন, সেই ভাষণে তাঁর আমিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ লক্ষ্যণীয়। উক্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধুর আমিত্বের প্রকাশ কিভাবে ঘটেছে, ভাষণে কতবার তিনি ‘আমি’ ‘আমার’ এবং ‘আমাকে’ বিষয়ক শব্দ ব্যবহার করেছেন, সেদিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে ভাষণটি শুরু করেন। এটি ব্যতিক্রমধর্মী সম্বোধন। শুরুতে বলেছিলেন- ‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। …আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। … নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। … আমি শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করলাম ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। …আমি বললাম, অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব, এমনকি আমি এও পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। …আমি বললাম, এ্যাসেম্বলি চলবে। তারপর হঠাৎ এক তারিখে এ্যাসেম্বলি বন্ধ করে দেয়া হলো। এয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসাবে এ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন, আমি বললাম যে, আমি যাবো। …তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেয়া হলো আমাকে। …আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কল-কারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। …আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী-আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে। …টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জনাব এয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপরে গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। …তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ তারিখ রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলেছি, কিসের আরটিসি? কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসব? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন।’
বক্তৃতার মাঝামাঝিতে এসে আবার তিনি উচ্চারণ করেছেন- ‘ভাইয়েরা আমার। ২৫ তারিখে এ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি দশ তারিখে বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদদের রক্তের ওপর দিয়ে, পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। এ্যাসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম।’ এরপর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু ক্রমেই কঠিন অবস্থানে চলে যেতে থাকেন, কঠিন কর্মসূচী ঘোষণা করতে থাকেন। যেমন- ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিতে চাই যে, আজ থেকে বাংলাদেশে কোর্ট, কাছারি, আদালত, ফৌজদারি, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য অন্যান্য যে জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। …এরপরে যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটি গুনি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল : প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে, সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। …তোমরা আমার ভাই- তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা কর না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। …যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। …সরকারী কর্মচারীদের বলি; আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হয় খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হবে। কেউ দেবে না।’
১৯ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু মোট ৪০ বার ‘আমি’ ‘আমার’ এবং ‘আমাকে’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। এই শব্দ ঘন ঘন উচ্চারণ করলেও শ্রোতাদের কাছে বিরক্তিকর মনে হয়নি, বরং শ্রুতিমাধুর্য বেড়ে গেছে এবং আরও হৃদয়স্পর্শী হয়েছে। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাড়া এত ‘আমি’ শব্দের ব্যবহার বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছাড়া অন্য কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। বঙ্গবন্ধু তাঁর সমগ্র জীবন ধরে অসংখ্য ভাষণ দিয়েছেন। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে ৭ মার্চের ভাষণে ‘আমি’ শব্দ ব্যবহারে যে ব্যাপকতা আছে, অন্য কোন ভাষণে তেমন নেই। ব্যতিক্রমধর্মী এই ভাষণে দেশবাসীকে এবং পাশাপাশি সমগ্র বিশ্ববাসীকে বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের অবস্থানের কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবের ব্যক্তিসত্তা এবং বাঙালি জাতিসত্তা মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন শুধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিভূ নন, তিনি নিজেই তখন বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন। শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশ তখন অভিন্ন। শেখ মুজিবের আমিত্ব তখন বাংলাদেশ জুড়ে পরিব্যপ্ত। এই অখ- আমিত্বকে ক্ষুদ্র গ-ির মধ্যে আবদ্ধ করার কোন সুযোগ নেই। এমন আমিত্বের প্রকাশ একমাত্র বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যেই মানায়, আর কারও বক্তব্যে নয়। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শুধু মুখ দিয়ে কথা বলেননি, হৃদয় দিয়ে কথা বলেছেন, সে কারণেই ৭ মার্চের ভাষণ এতটা হৃদয়স্পর্শী। বঙ্গবন্ধুর আত্মপ্রত্যয় ছিল সে দিন আকাশচুম্বী। ৭ মার্চের আগে এবং পরে বঙ্গবন্ধু অনেক ভাষণ দিয়েছেন, তবে ৭ মার্চের ভাষণ অতুলনীয়। এটি তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ। যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ যুগ যুগ ধরে বিশ্বের নিপীড়িত স্বাধীনতাকামী মানুষদেরকে পথ দেখাবে। ৭ মার্চের ভাষণের অন্তর্নিহিত সত্য আবিষ্কারে উচ্চতর গবেষণা সবেমাত্র শুরু হয়েছে, শেষ হতে সময় লাগবে। এ পর্যন্ত ৭ মার্চের ভাষণের যতখানি মূল্যায়ন হয়েছে, তার মর্মকথাÑ মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু একজন অসাধারণ মনোবিজ্ঞানী, ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে তিনি একজন অসাধারণ ইতিহাসবিদ, দার্শনিকের দৃষ্টিতে তিনি একজন বড় মাপের দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে তিনি একজন অসাধারণ সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিতে তিনি একজন বড় মাপের অর্থনীতিবিদ, কবির দৃষ্টিতে তিনি একজন উচ্চমানের কবি, কূটনীতিবিদের দৃষ্টিতে তিনি একজন অসাধারণ কূটনীতিবিদ। এসব মূল্যায়ন থেকে বলা যায়, ৭ মার্চের ভাষণ গতানুগতিক নয়। ভাষণ অসাধারণ এবং ব্যতিক্রমধর্মী। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাংলাদেশের মানুষ থাকবে, বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র থাকবে, ততদিন ৭ মার্চের ভাষণের ক্ষয় নেই, লয় নেই। যুগ যুগ ধরে এই ভাষণে বাংলার মানুষ প্রাণিত হবে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, জনপ্রিয়তা এবং শ্রোতা সংখ্যার বিচারে সমগ্র বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শীর্ষে অবস্থান করছে। এমন আত্মপ্রত্যয়দীপ্ত ভাষণ পৃথিবীতে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না ।