সিলেটে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে নারীরাও ॥ সেবকের তালিকায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক থেকে শুরু করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রী পর্যন্ত

216

সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
সিলেটে ইয়াবা ব্যবসা দিনদিন বেড়েই চলছে। আর এ ব্যবসায় ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে নারীরাও। প্রতিদিন আইন শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইয়াবা ও বিভিন্ন জাতের মাদকদ্রব্য উদ্ধারসহ অপরাধীদের গ্রেফতার করলেও তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না তারা।
আইন শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদকের বিরুদ্ধেজিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও মাদক ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে না খুচরা ও পাইকারী মাদক ব্যবসায়ীরা। তারা তাদের ব্যবসা নির্ভয়েই চালিয়েই যাচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন যুব সমাজ দিন দিন এসব মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে তারা চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও খুনসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এতে করে অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরাও দিনদিন ইয়াবা সেবনে ঝুঁকছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার, টেকনাফ ও সিলেট সীমান্ত দিয়ে নানা কৌশলে সিলেটে প্রবেশ করছে ইয়াবা। পাইকারি বিক্রেতাদের মাধ্যমে হাতবদল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিভাগজুড়ে। প্রায় প্রতিদিনই সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ব্যবসায়ীদের আটক কিংবা গ্রেফতারও করছে। সিলেটে বেশ কয়েকটি অভিযানে গ্রেফতারও হয়েছে খুচরা বিক্রেতারা। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে মূল হোতারা। এ ছাড়া কিছু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে সুন্দরী নারীরাও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ায় তরুণ ও যুবকদের নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সিলেটে ইয়াবার একাধিক শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যরা টাকার লোভে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ওই ব্যবসায় নারীদের আগমনও ঘটেছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন নারী মাদক ব্যবসায়ীও গ্রেফতার হয়েছে।
গত ২৬ জানুয়ারি নগরীর দাড়িয়াপাড়ার একটি বাসা থেকে ইয়াবা ব্যবসা ও নারীদের জোরপূর্বক দেহব্যবসায় বাধ্য করার অভিযোগে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের এসআই রোকন উদ্দিন ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ সময় গ্রেফতার করা হয় ইয়াবা ব্যবসায়ী রীমা বেগমকে। এ ছাড়া গত ২৩ জানুয়ারি ফারুক আহমদ ওরফে কালা ফারুক, মাছিমপুরের মণিপুরিপাড়ার ফারুক আহমদের পুত্র ফেরদৌস আহমদ বাবলু এবং নগরীর ৪১ কলবাখানির আবদুল হকের পুত্র ফজলুল হককে ১১২ পিস ইয়াবাসহ আটক করে। গত ২৯ জানুয়ারি নগরীর তালতলা বিলাস হোটেল থেকে ১৩৫ পিস ইয়াবাসহ সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই থানার গোলাপনগর গ্রামের সামসুল হকের পুত্র কামাল হোসেনকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। গত ৩০ জানুয়ারি নয়াসড়ক এলাকা থেকে ৫০ পিস ইয়াবাসহ মাদক বিক্রেতা শাহিদা পারভীন প্রীতিকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গত ২৪ ফেব্র“য়ারী শাহপরাণ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২৩০ পিস ইয়াবাসহ শাহপরাণ থানার মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ গুচ্ছগ্রামের আবদুল মালেকের স্ত্রী রেবেকা সুলতানা ও তার ভাগ্নে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি থানার মধ্যমপাড়া গ্রামের মো. আবদুল কালামের পুত্র মো. দেলোয়ার হোসেনকে আটক করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে নগরী ও এর আশপাশ এলাকা এবং সীমান্তে একাধিক শক্তিশালী চক্র ইয়াবা ব্যবসা করে আসছে। বিশেষ করে দক্ষিণ সুরমার পুরনো ও নতুন রেলওয়ে স্টেশন, একই এলাকার চান্দের বাড়ি, ডগরপার, আখতারের কলোনি, কিনব্রিজের নিচে, চাঁদনীঘাট, ঝালোপাড়া, বাস টার্মিনাল, টিলাগড়, নগরীর কাষ্টঘরের সুইপার কলোনি, মুন্সীপাড়া শফিকের কলোনি, মহাজনপট্টি, লালদীঘিরপাড়, কিনব্রিজ সংলগ্ন সুইপার কলোনি, ভার্থখলা, এবং শহরতলির সালুটিকর, শাহপরাণ বাজার এলাকা, টুকেরবাজার নদীরপাড়, বিমানবন্দর এলাকার রঙিটিলায় ইয়াবা ব্যবসা জমজমাট।
এছাড়া নগরীর কাস্টঘরের ইয়াবা ‘কিং’ নামে পরিচিত নূপুর লাল মরণ নেশা ইয়াবার পাইকারি আড়তদার। ডিলাররা ইয়াবা সংগ্রহ করে তার কাছ থেকেই। কোটি কোটি টাকার মাদক ব্যবসা তার। নূপুর রতনের মেয়ে। বয়স ৩০ কিংবা ৩২। স্বামীর সংসারে আছেন। পিতার সাম্রাজ্যের হাল ধরে নূপুর। ধীরে ধীরে নূপুরও হয়ে ওঠে ইয়াবা সম্রাজ্ঞী। কাস্টঘরে এক নামেই চিনে সবাই। স্থানীয়রা জানিয়েছেন,নূপুর লালের পুরো পরিবার অনেক আগে থেকেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের ঘর কাস্টঘরের মাদকসেবীদের কাছে পরিচিত।
সিলেটের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, সর্বনাশা ইয়াবা আর ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদকদ্রব্যের যেন উন্মুক্ত বাজার সিলেট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ মদদও রয়েছে এ ব্যবসায়। স্কুল-কলেজের ছাত্র, যুবসমাজ তাদের মূল লক্ষ্য। এ নিয়ে সিলেটের অভিভাবকমহল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
বর্তমানে রেল স্টেশন ছাড়িয়ে কদমতলী, টার্মিনাল, পুলের মুখ, ডগেরপার, কাষ্টঘর, মাছিমপুর, মহাজনপট্টি, জেল রোড ও তালতলা, শাহপরাণ-বাইপাস মাজার সংলগ্ন এলাকায় দেদারসে ভাসমান বিক্রেতারা ইয়াবা মাদক বিক্রি করছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদক ব্যবসায়ীদের রয়েছে খুচরা বিক্রেতাদের একটি দল। এই দলে কিছু ভাড়াটে নারী-পুরুষ রয়েছেন। আছে শিশু বিক্রেতারাও। তাদের হাতে কাগজে, দেশলাইয়ের বাক্সে পুরে দশ থেকে ৫০ টি ইয়াবা বড়ি বিক্রির জন্য দেওয়া হয়। ভালোমানের ইয়াবা প্রতিটি ৪ শ টাকা, নিম্নমানের ইয়াবা ১৫০ টাকা করে বিক্রি করেন এসব ভাসমান বিক্রেতারা। তাদের কমিশন দেন মূল ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। তাই তারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশি অভিযানে মাঝেমধ্যে দুচারজন আটক করা হলেও মূলহোতারা কৌশলে আদালত থেকে তাদেরকে জামিনে মুক্ত করে আনেন খুব সহজেই।
ইয়াবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তথ্য বলছে, নিয়মিত ইয়াবা সেবন করলে মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরন, নিদ্রাহীনতা, খিঁচুনি, ক্ষুধামন্দা এবং মস্তিষ্ক বিকৃৃতি দেখা যেতে পারে। ইয়াবা গ্রহণের ফলে ফুসফুস, বৃক্ক সমস্যা ছাড়াও অনিয়মিত এবং দ্রুতগতির হৃৎস্পন্দনের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত হারে ইয়াবা গ্রহণ হাইপারথার্মিয়া বা উচ্চ শারীরিক তাপমাত্রার কারণ হতে পারে। অভ্যস্ততার পর হঠাৎ ইয়াবার অভাবে সৃষ্টি হয় আত্মহত্যা প্রবণতা এবং হতাশা। দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা খেলে স্মরণশক্তি কমে যায়, সিদ্ধান্তহীনতা শুরু হয় এবং কারও কারও ক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকে পাগল হয়ে যায়। এটি মূলত মেথঅ্যাম্ফিটামিন ও ক্যাফেইন এর মিশ্রনে তৈরি। ইয়াবা ট্যাবলেট থাইল্যান্ডে জনপ্রিয়।
জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ইয়াবার আবির্ভাব ঘটে। এর পর ২০০০ সাল থেকে মায়ানমার থেকে প্রচুর ইয়াবা আসতে শুরু করে বাংলাদেশে। যা বর্তমানে মহামারি আকার ধারন করলে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া এন্ড কমিউনিটি সার্ভিস) মোঃ জেদান আল মুসা জানান, আসলে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স আমাদের রয়েছে। যেখানেই খবর পাই সেখান থেকেই প্রতিদিন আমরা মাদক বিশেষ করে ইয়াবাসহ খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতাদের গ্রেফতার করছি। এভাবে গ্রেফতার করতে করতেই এক সময় হয়তো মাদক কেনা-বেচা বন্ধ হবে। এছাড়া পাইকারী মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করতে পুলিশ বিভিন্ন কৌশলে কাজ করছে। তিনি বলেন, ইয়াবা ব্যবসার সাথে সব শ্রেণীর কিছু না কিছু লোক জড়িত রয়েছে। তাদেরকেও চিহ্নিত করে গ্রেফতারের আওতায় আনা হচ্ছে।
গতকাল রবিবার রাত ৯ টার দিকে র‌্যাব-৯ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া অফিসার) মোঃ মনিরুজ্জামানের সাথে এ ব্যাপারে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি অপারেশনে রয়েছেন বলে লাইন কেটে দেন।