প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয় – অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

18
শ্রীমঙ্গলের প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রজনৈতিক সুরক্ষা শীর্ষক সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বের প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘গত কয়েক বছরে নারী ও শিশু মৃত্যুর হার, শিশু শিক্ষার হারসহ বিভিন্ন সামাজিক সুচকে বাংলাদেশ অনেকটা এগিয়ে গেছে। কিন্তু মোট জনসংখ্যার তিন থেকে চার শতাংশ মূল ধারার বাইরে থাকা প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী এই উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত। এদের বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। সম্ভব নয়, ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্রসীমা অতিক্রম করা।’
বৃহস্পতিবার (২২ নভেম্বর) মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রজনৈতিক সুরক্ষা শীর্ষক দুই দিনের সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক উৎসবে উদ্বোধনী পর্বের প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এ কথা বলেছেন। সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড), পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি), খ্রিস্টিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (সিসিডিবি) এবং গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র (জিবিকে)Ñযৌথভাবে এই সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করেছে।
‘টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্র অনুযায়ী আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে চাই। কিন্তু যদি আমরা দেশের প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের মূলধারায় নিয়ে আসতে না পারি তাহলে তা সম্ভব নয়। এজন্য সরকারকেই কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে,’ উদ্বোধানী অনুষ্ঠানে আরো বলেন অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। ‘নানাভাবে আমাদের সমাজে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। যাদের সবাই দরিদ্র। এদের সবার সমস্যা এক ধরনের নয়। তাই একটি প্রকল্প বা একই পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের সবাইকে উন্নয়নের ধানায় আনা সম্ভব নয়। স্ব স্ব জনগোষ্ঠীর সমস্যা চিহ্নিত করেই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে।’
‘টেকসই উন্নয়নের বড় শর্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা। এজন্য বন, পাহাড়, জলাশয়, প্রাকৃতিক সম্পাদক রক্ষা করতে হবে। আর সেটা করতে পারলে টেকসই উন্নয়ন যেমন হবে, তেমনি প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত হবে,’ বলেন অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেড’র পরিচালক ফিলিপ গাইন। সম্মেলনে প্রায় ৬০টি জাতিগোষ্ঠীর তিন শতাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে আটটি সেশনে দেশের প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনমান, সামাজিক সংকটসহ তাদের ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হচেছ।
সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বের সভপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বতর্মান পৃথিবীর উন্নয়নের নতুন চিন্ত,া ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’। এজন্য আমরাও কাজ করছি, যার অংশ হিসেবে গত বছর রংপুরে এমন একটি সম্মলনের আয়োজন করা হয়। এসব আয়োজনের মাধ্যমে আলোচনার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যাতে সরকারের নীতি নির্ধারকরা সবাইকে উন্নয়নের ধারায় আনার পরিকল্পনা করেন। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করাই আমাদের লক্ষ্য।’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযু্িক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘চা শ্রমিকরা চরমভাবে শোষণের শিকার হচ্ছেন। গ্রামের একজন কৃষক বা শহরের একজন রিকসাচালক প্রতিদিন অন্তত ৫০০ টাকা আয় করেন। কিন্তু একজন চা শ্রমিকদের মজুরী মাত্র ১০২ টাকা। এটা অত্যন্ত অমানবিক। অনেকে বলেন, চা বাগান টিকিয়ে রাখতে শ্রমিকদের টিকিয়ে রাখতে হবে। এটা কোনো কথা হতে পারে না। চা বাগান টিকিয়ে রাখার চেয়ে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ লেখাপড়ার মাধ্যমে শ্রমিকদের সন্তানদের প্রকৃতভাবে মানুষ করা। এজন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সন্তানদের ভর্তিও জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। আমরা তাদের শিক্ষা চালিয়ে নিতে ভাতার ব্যবস্থা করেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সবাইকে যার যার স্থান থেকে সমাজকে এগিয়ে নিতে কাজ করতে হবে। তাহলেই মানুষের সমাজে মানবতা প্রতিষ্ঠা পাবে।’
উদ্বোধনী পর্বে আরো বক্তব্য রাখেন মৌলবীবাজার জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম, অধ্যাপক হরিশঙ্কর জলদাস, পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাবেক মহাপরিচালক ড. আব্দুল ওয়াজেদ, সুলেখা ¤্রং, চা বাগান মালিক প্রতিনিধি আব্দুল আওয়ায়, বাংলাদেশে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি আব্দুল কাদের, গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের মুয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ।
সন্ধ্যায় খাসি, মণিপুরী, শব্দকর, মাদল এবং আদিবাসী চা জনগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক দলের অংশগ্রহণে পরিবেশিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।