জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি

326

মো: শামসুল ইসলাম সাদিক

মানব জাতি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরিত। উদ্দেশ্য হল: মানুষ এক আল্লাহর দাসত্ব করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না, সার্বিক জীবন একমাত্র অহীর বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করবে, রাসূল (সা:) এর আর্দশকেই একমাত্র আর্দশ হিসেবে গ্রহণ করবে। প্রতিপালক আল্লাহ তাঁর এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মানব জাতির জন্য ইসলামকে একমাত্র দ্বীন হিসেবে মনোনীত করে তাঁর যাবতীয় বিধি-বিধান, অহী মারফতে জানিয়ে দিয়েছেন।
পথ প্রদর্শক হিসেবে যুগে যুগে নবী- রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। প্রভু তাঁর আনুগত্যশীল বান্দাদের সম্মানিত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন চির শান্তির জায়গা জান্নাত। আর অমান্যকারিদের লাঞ্চিত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন চির জাহান্নাম। মৃত্যুর পরেই মানুষের অবস্থান স্থল নির্ধারিত হবে। সৎকর্মশীল হলে জান্নাত এবং অসৎকর্মশীল হলে জাহান্নামে চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করবে। জান্নাতের সুখ যেমন- মানুষের কল্পনার বাহিরে। জাহান্নামের শাস্তিও তেমনি মানুষের কল্পনার বাহিরে। এ বিষয়ে আমরা আল- কোরআন ও আল- হাদিসের আলোকে জাহান্নামের শাস্তির স্বরূপ তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
আল- কোরআনের সূরা আল-ইমরানের ১৩১ নং আয়াতে সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত- তোমরা জাহান্নামকে ভয় কর যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য। অন্যত্রে সূরা- নাবার ২১-২২ নং আয়াতে বর্ণিত আছে- নিশ্চয়ই জাহান্নাম গোপন ফাঁদ। সীমালংঘনকারীদের জন্য প্রত্যাবর্তন স্থল।
পবিত্র হাদিসের আলোকে বর্ণনা পাওয়া যায় যে, জাহান্নামের শাস্তি প্রাপ্তদের কে কি করে উপস্থিত করা হবে। হযরত আনাস ইবনু মালিক (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বললেন- কাফিরদেরকে হাশরের মাঠে মুখের মাধ্যমে হাঁটিয়ে উপস্থিত করা হবে। তখন এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! মুখের ভরে কাফিরদেরকে কিভাবে হাশরের ময়দানে উঠানো হবে ? তিনি বললেন, দুনিয়াতে যে সত্তা দু’ পায়ের উপর হাঁটান, তিনি কি কিয়ামতের দিন মুখের ভরে হাঁটাতে পারবেন না ? তখন কাতাদাহ (রা:) বললেন, আমাদের প্রতিপালকের ইয্যতের কসম ! অবশ্যই পারবেন। মি’রাজ রজনীতে রাসুলে পাক (সা:) স্বচক্ষে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি অবলোকন ও কতিপয় কয়েকটি কাজের শাস্তির কথা উলেখ এমনি ভাবে পাওয়া যায়।
গীবতের শাস্তি : রাসূলে পাক (সা:) ইরশাদ করেন, আমি এমন একদল লোকের কাছ দিয়ে গেলাম যাদের নখ ছিল তামার। তাঁরা এ নখ দিয়ে আপন মুখমন্ডল ও বুক আঁড়াচ্ছিলো। আমি জিব্রাইল (আ:)- কে জিজ্ঞেস করলাম এরা কারা ? তিনি জবাব দিলেন, এরা সে সব লোক, যারা মানুষের গোশত খায়। অর্থাৎ একে অপরের গীবত করে। অপর এক বর্ণনায় রাসূলে পাক (সা:) বলেন, আমার দৃষ্টি পড়ল দোযখের উপর। একদল মানুষকে মৃত খেতে দেখে জিব্রাইল (আ:)- কে জিজ্ঞেস করলাম- এরা কারা ? তিনি উত্তর দিলেন, এরা সে সব লোক, যারা মানুষের গোশত খায়। এ সম্পর্কে অন্য হাদিসে আছে, আমি এমন কিছু লোককে দেখলাম যাদের বাহুর গোশত কাটা হচ্ছে। তাদের প্রত্যেককে বলা হচ্ছে, খাও- যেমন তুই তোর ভাইয়ের গোশত খেতে। আমি জানতে চাইলাম- এরা কারা ? জিব্রাইল (আ:) বলেন: এরা আপনার উম্মতের সে সব লোক, যারা পশ্চাতে পরনিন্দা এবং প্রকাশ্যে তিরষ্কার করে।
আমলহীন বক্তার শাস্তি : রাসূল (সা:) -ইরশাদ করেন, আমি এমন একদল লোকের দেখা পেলাম, যাদের জিহ্বা ও ঠোঁট (দোযখের আগুনে তৈরী) কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। যখনই ঠোঁট কাটা হয়, তখনই আবার পূর্বের ন্যায় হয়ে যায়। আমি তখন হযরত জিব্রাইল (আ:)- কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, এরা আপনার উম্মতের সে সব বক্তা, যারা এমন বিষয় বয়ান করে যে বিষয়ে নিজেদের আমল নেই।
সুুদখোরের শাস্তি: বিশ্বনবী রাসূল (সা:)- ইরশাদ করেন, আমি এক ব্যক্তিকে দেখলাম, সে নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে (কিনারায় উঠার সুযোগ পাচ্ছে না), পাথর মেরে তাকে হটিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, সে হল সুদখোর। অপর বর্ণনায় রয়েছে, আমি এমন লোকদেরকে দেখলাম, যাদের পেট এক একটি ঘরের মতো বড়। তাদের কেউ দাঁড়ালে তৎক্ষণাৎ পড়ে যায়। পেটের ভিতর অনেক সাপ কিলবিল করছে, সেগুলো স্পষ্ট রূপেই দেখা যাচ্ছে। জিব্রাইল (আ:)- কে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দিলেন, এরা সুদখোর।
হারাম খাওয়ার শাস্তি: প্রিয়ারা রাসূল (সা:)- ইরশাদ করেন, আমি এক স্থানে দেখতে পেলাম অনেকগুলো দস্তারখান বিছানো আছে, তার উপর রান্না করা ভাল ও উত্তম গোশত রয়েছে। কিন্তু তথায় উপস্থিত লোকগুলোর কেউ ঐ গোশতের নিকটেও যায় নি। এরপর নিকটেই আমি আরো কিছু দস্তারখান দেখতে পেলাম, যার উপর অতি দুর্গন্ধময় পঁচা গোশত রয়েছে। ঐ লোকগুলো তাই খাচ্ছে। আমি জানতে চাইলাম এরা কারা ? হযরত জিব্রাইল (আ:) বলনে- এরা আপনার উম্মতের সে সব লোক, যারা হালাল ছেড়ে হারাম খায়।
ইয়াতিমের সম্পদ ভোগের শাস্তি : মানবতার মুক্তির দূত রাসূল (সা:) -ইরশাদ করেন, আমি এমন একদল লোককে দেখলাম, যাদের ঠোঁট উটের ঠোঁটের মতো বড় বড়। বল প্রয়োগ করে তাদের মুখ খোলে ভিতরে পাথর প্রবেশ করানো হচ্ছে। সে পাথর তাদের মল্লার দিয়ে বের হচ্ছে। এতে তাঁরা ভীষণ চিৎকার করছে। আমি এদের পরিচয় জানতে চাইলে জিব্রাইল (আ:) বলেন, এরা আপনার উম্মতের সে সব লোক যারা ইয়াতিমের মাল অন্যায়ভাবে খায়।
যিনার শাস্তি : রাসূলে পাক (সা:) বলেন- আমি এমন একদল মহিলাকে দেখলাম, যারা নিজেদের স্তনে বাঁধা অবস্থায় ঝুলছিল। এতে তাদের খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে। এ কষ্ট থেকে উদ্ধারের জন্য উচ্চ আওয়াজে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছে। আমি হযরত জিব্রাইল (আ:)- কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা ? জিব্রাইল (আ:) জবাবে বললেন- এরা আপনার উম্মতের সে সব মহিলা, যারা ব্যভিচারে লিপ্ত হয় এবং সন্তান হত্যা করে।
বেনামাজির শাস্তি : বেনামাজির শাস্তি সম্পর্কে রাসূল (সা:)- ইরশাদ করেন- আমি এমন একদল লোককে দেখলাম, যাদের মাথা বড় বড় পাথরের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হচ্ছে। মাথা চূরমার করার পর মুহূর্তেই আবার পূর্বের ন্যায় হয়ে যাচ্ছে। তাদের এ কার্যধারা অবিরত চলছে। আমি হযরত জিব্রাইল (আ:)- কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা ? হযরত জিব্রাইল (আ:) উত্তরে বললেন- এরা আপনার উম্মতের সে সব লোক, যারা ফরয নামাজ আদায়ে অলসতা করত।
পরকীয়ার শাস্তি : যারা অবৈধ ভাবে পরকীয়ায় লিপ্ত হয় তাদের সম্পর্কে রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন- আমি এমন একদল লোককে দেখলাম, যাদের সামনে এক পাত্রে রান্না করা গোশত, অপর পাত্রে পঁচা দুর্গন্ধ যুক্ত কাঁচা গোশত রয়েছে। তারা রান্না করা গোশত না খেয়ে কাঁচা গোশত খাচ্ছে। আমি তাদের পরিচয় জানতে চাইলে, হযরত জিব্রাইল (আ:) বললেন- এরা সে সব পুরুষ যাদের ঘরে হালাল ও পবিত্রা স্ত্রী রয়েছে। কিন্তু এর পরও তারা নাপাক নারীদের কাছে যায় এবং রাত্রী যাপন করে। ঠিক অনুরূপ ভাবে এরা সে সব মহিলা, যারা আপন স্বামীর কাছ থেকে উঠে অন্য কোনো পুরুষের কাছে আসে এবং সকাল পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে।
যাকাত না দেয়ার শাস্তি : রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন- আমি এমন একদল নর-নারীকে অবলোকন করলাম যে, যাদের সামনের ও পিছনের লজ্জা স্থানে ন্যকড়া ঠেসে রাখা হয়েছে এবং তারা উঠের মতো বিচরণ করে ঝাক্কুম, নুড়ি, জাহান্নামের কাঁকর ও পাথর খাচ্ছে। আমি তাহাদেরকে দেখে হযরত জিব্রাইল (আ:) কে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা ? জবাবে হযরত জিব্রাইল (আ:) বললেন- এরা সে সব লোক যারা যাকাত আদায় করতো না।
অপ্রাসঙ্গিক কথা বলার শাস্তি : অধিক ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা বলা সম্পর্কে রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন- আমি দেখতে পেলাম ছোট একটি পাথরখন্ড, যার মধ্য থেকে একটি বড় বলদ সৃষ্টি হয়। এরপর এ বলদ পাথরটির ভিতরে যেতে চেষ্টা করে। তবে যেতে পারেনা। এ সকল অবস্থা দেখে আমি হযরত জিব্রাইল (আ:)- কে জিজ্ঞেস করলে, তিনি জবাবে বললেন- এরা সে সব লোক যারা একটি বড় কথা উচ্চারণ করে, অত:পর এজন্য অনুতাপ করে কিন্তু কথাটি ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয় না।
আলোচনার পরিশেষে আল- কোরআন ও আল-হাদিসের বর্ণনামতে জীবন পরিচালনা করা আমাদের সকল মুমিন মুসলমানের অবশ্যই অবশ্যই দায়িত্ব ও কর্তব্য। যা আমাদের জন ইহকাল ও পরকালে নাযাত পাওয়ার উছিলা হতে পারে। তাই আল্লাহ ও রাসূল (সা:) এর দেখিয়ে দেয়া পথ বুঝার ও আমল করার সকল মুসলমানের প্রতি তাওফিক দান করুন। আমিন