জনস্বাস্থ্যের চিন্তা মুক্তির উপায় কি ?

113

রেজা সেলিম

আসন্ন নতুন সরকারের জন্য প্রধান ভাবনার বিষয় কি কি হতে পারে এই নিয়ে অনেকেই চিন্তা-ভাবনা করছেন। আমার মতে, চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সংবিধানের মৌলিক প্রতিশ্র“তিগুলোর অন্যতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ ও এই সেবার মান উন্নয়ন জরুরী। নতুবা আমরা জানি যে, স্বাস্থ্য বিপর্যয় একটি পরিবার এমনকি একটি জাতিকেও ধ্বংসের চূড়ান্ত মুখে নিয়ে যেতে পারে, যদি না সে বিষয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র সতর্ক না থাকে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে যে যত প্রশ্নই করুক, আমি নিজে একজন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে মনে করি- এক্ষেত্রে আমাদের দেশের যথেষ্ট সামর্থ্য অর্জিত হয়েছে। শুধু দুটি প্রধান বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের মনোযোগ দেয়া দরকার, তা হলোÑ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা। আসন্ন নির্বাচনের পর নতুন যে সরকার আসবে তাদের এখন থেকেই গুরুত্ব দিয়ে এই দুটি বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।
দেশের সরকারী–বেসরকারী যে সেবা কেন্দ্রেই আপনি যান দেখবেন কোথাও কোন সুব্যবস্থাপনার বালাই নেই। ঢাকার কোন নামকরা প্রাইভেট হাসপাতালে গেলে দেখবেন স্বাগত কেন্দ্রে শার্ট-প্যান্ট-টাই পরা ছেলেমেয়েগুলো আপনাকে অযাচিত প্রশ্ন করবে ও আপনার প্রশ্নের উল্টো উত্তর দেবে! অর্থাৎ আপনি আপনার মনের মতো কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পাবেন না। এর প্রধান কারণ এই ছেলেমেয়েগুলোকে মালিক চাকরি দিয়েছে ঠিকই কিন্তু ‘কাস্টমার কেয়ার’ বলতে যা বোঝায় তার মধ্যে শুধু শিখিয়েছে কেমন করে রোগীকে দ্রুত ক্যাশ কাউন্টারে নিয়ে পৌঁছে দেয়া যায়। তার আগে যে আপনার মনে হাজারটা প্রশ্ন সেসবের উত্তর আপনি পাবেন না। আপনার মন বুঝতে তাকে কোন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি, দেখবেন তাদের মুখে কোন হাসি পর্যন্ত নেই। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসা মানুষের জন্য এক চিলতে হাসিমুখের সম্ভাষণ যে কতটা প্রয়োজন- আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপকরা তা জানেন না বললেই চলে।
জরুরী সেবার জন্য সরকারী কেন্দ্রে যাবেন তো দেখবেন হৈচৈ আর ধমক! আপনার বৃদ্ধ বাবা বুকের ব্যথায় কুঁকড়ে গেছেন আর তখন তাকে ওয়ার্ড বয় বা একজন দালাল এসে বলবে ‘টিকেট নিয়ে আসেন’ আর সে টিকেটের দামে একটা খুচরো পয়সাও যুক্ত আছে। কত বড় প-িত স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ যে, এই ‘ইউজার ফি’ হিসাব সরকারকে ধার্য করে দেন। খোঁজ-খবর করে তার বা তাদের দেখা পাইনি তবে সরকারের একজন বুদ্ধিমান কর্মকর্তা তা ফাইলে অনুমোদনের আগেই ধরে ফেলা উচিত। সে কাজটি হয়নি বলে দেশের উদ্বিগ্ন মানুষকে হাসপাতালের বারান্দায় ভাংতি টাকার জন্যে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, আবার ৫ টাকার বদলে একেবারেই ১০-২০ টাকা কাউন্টারে দিয়ে সিøপ নিয়ে এসে ডাক্তারকে দিতে হয় না হলে আবার চিকিৎসাই শুরু হবে না।
প্রাইভেট হাসপাতাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে মনযোগ দেয়, যার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যই বেশি। আমার নিজের গবেষণায় একশ’ ব্যবস্থাপত্রের মধ্যে ৬৯টি ব্যবস্থাপত্র পাওয়া গেছে যেগুলোতে রোগীর রোগ-অভিযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন পরীক্ষার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এসব অযাচিত পরীক্ষায় রোগীকে যেমন টাকা খরচ করতে হয় তেমনি দৌড়ঝাঁপ বা হাসপাতালের নিচ-ওপর করতে হয় যার কোন যুক্তি নেই। আমার অনেক চিকিৎসক বন্ধু বলেছেন, কিছু অতিরিক্ত পরীক্ষা না দিলে মালিক মনক্ষুণœ হন।
আমাদের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো সাজানো উচিত ‘ওয়ান স্টপ’ সেবার আলোকে যেখানে সব সেবা একসঙ্গে কেন্দ্রীভূত থাকবে। কাউকে কোথাও দৌড়াতে হবে না, এই বিল্ডিং ওই বিল্ডিং আর এই কেন্দ্র ওই কেন্দ্রে যেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিরিয়াল দিতে হবে না। এখানে আরও একটি বিষয় জরুরী, যারা আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোর নক্সা করেন তাদের চিকিৎসা কেন্দ্র নির্মাণ কৌশলের জ্ঞান খুবই সামান্য। চিকিৎসা কেন্দ্রের নক্সা করেন স্কুল ঘরের মতো বা গুদামের মতো। এবড়ো খেবড়ো এসব ঘর বারান্দা ডিঙিয়ে শেষে মানুষের মনে সংশয় হয় এই ভেবে যে, ‘সেবা’ শব্দটি ‘চিকিৎসা’ থেকে হারিয়ে গেল কেন? অনেকেই হয়ত জানেন, ক্যান্সার চিকিৎসার জন্যে রেডিওথেরাপি একটি জরুরী অনুষঙ্গ, সরকার অনেক কোটি টাকা দাম দিয়ে এটি কিনে গত ৮ বছরেও খুলনা মেডিক্যাল কলেজে চালু তো দূরের কথা স্থাপনই করতে পারেনি। কারণ সে মেশিনের জন্যে প্রয়োজনীয় বিল্ডিং বিধি মোতাবেক তৈরি হয়নি! উল্লেখ্য, খুলনা বিভাগের কোন জেলাতেই রেডিওথেরাপি চিকিৎসা সেবার কোন ব্যবস্থা নেই।
আমাদের প্রতি জেলায় একটি সদর হাসপাতাল ও প্রতি উপজেলায় একটি করে স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে। জেলার লোক সংখ্যা অনুপাতে একটি সদর হাসপাতাল ও প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ও পরিবার কল্যাণ কর্মী, হালে স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা দেশের মানুষের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দিতে ও রোগী কল্যাণ নিশ্চিত করতে যথেষ্ট। ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন যদি সরকারের তরফ থেকে সঠিকভাবে হয়Ñ এদেশের স্বাস্থ্য সেবায় উচ্চ দামের ফাইভ স্টার হোটেলের মতো হাসপাতালের কোনই দরকার নেই। সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বিশেষায়িত হাসপাতালের ও মেডিক্যাল উচ্চ শিক্ষা (কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়) স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখন দরকার দেশের মানুষের স্বাস্থ্যমান বজায় রাখা, অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা মান উন্নয়ন করতে গবেষণা করে চিকিৎসা দিতে আত্মবিশ্বাসী থাকা যাতে শিক্ষিত সেবা পরায়ণ চিকিৎসক নিজেদের ‘সেবক’ মনে করতে পারবেন। সেবকের সম্মান টাকাওয়ালা বা ধনকুবেরের চেয়ে অনেক বেশি, এ কথা কে না জানে!
বাংলাদেশের মৌলিক মেডিক্যাল গবেষণা অভিজ্ঞতা দুর্বল এটা আমরা জানি কিন্তু কমিউনিটি চিকিৎসা সেবা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের সামাজিক গবেষণায় আমাদের অগ্রগতি অনেক। জনসংখ্যা সীমিতকরণ, টিকাদান ও যক্ষাসহ অন্যান্য ছোঁয়াচে রোগ নিয়ন্ত্রণে আমাদের সাফল্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এখন যেসব অসংক্রামণ রোগ (প্রধানত ক্যান্সার, কিডনি, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিস) দুনিয়ার অন্যান্য দেশের মতো আমাদের ওপর জেঁকে বসেছে তার জন্যে প্রয়োজন প্রচুর চিকিৎসা গবেষক ও গবেষণা উদ্যোগ। সরকারের মেডিক্যাল উচ্চ শিক্ষা কর্মসূচী বাস্তবায়নেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষক-গবেষকের প্রয়োজন হবে। সে পরিকল্পনা এখন থেকে নেয়া দরকার যেন নতুন সরকার এসে এক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। অসংক্রামক রোগব্যাধির ‘নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা’ সে পরিকল্পনার একটি বড় মাধ্যম হতে পারে।
চিকিৎসা গবেষণায় আমাদের নিয়মিত ও স্বীকৃত জার্নাল নেই যার মাধ্যমে আমরা আমাদের গবেষণার ফলাফলগুলো বিশ্বের দরবারে হাজির করতে পারি। এক্ষেত্রে আমাদের প্রধান দুর্বলতা সম্পাদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা। সরকারের একটি নীতিমালা থাকা দরকার যাতে গবেষণা পত্রগুলো নিয়মিত প্রকাশনা হয় ও সেসবের মান উচ্চ শিক্ষায় প্রয়োগ হয়।
গত দশ বছরে বাংলাদেশের সামাজিক খাতের যে যে ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছে সেসবের তুলনায় স্বাস্থ্য ক্ষেত্র কিছুটা পিছিয়ে আছে যার প্রধান কারণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও নিত্য নতুন গবেষণা তথ্য হাতের কাছে না থাকা। অথচ আমাদের নিবেদিত চিকিৎসক সমাজ সগৃহে চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না কিন্তু মেডিক্যাল ট্যুরিজমের নামের প্রলোভনে দেশের মানুষ আস্থা হারিয়ে ভিন দেশে যাচ্ছেন নিজের শরীরটা কেমন আছে তা দেখতে আর সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের এখন সময় হয়েছে ‘আমার দেশেই আমার সেবা’ সে দেশপ্রেমের প্রমাণ দেয়া।