বিদ্যুৎ বিল নিয়ে ভোগান্তি, ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা, অফিসে পুলিশ মোতায়েন

187

সিলেটে বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তাদের যথাযথ তদারিক আর কর্মচারি গাফিলতির কারণে এবার বিল নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন সাধারণ মানুষ। তামাশা শুরু করেছেন বিদ্যুৎ অফিসে কর্মকর্তরা। তাদের গাফিলতি আর কর্ম অদক্ষতার মিশ্রণে তৈরী বিদ্যুৎ বিল পেয়েই গ্রাহকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ‘অস্বাভাবিক বিল’ নিয়ে সিলেটে বিদ্যুতের কয়েক হাজার গ্রাহকের ত্রাহি অবস্থা। অতিরিক্ত হারে হঠাৎ বিদ্যুৎ বিল পেয়ে সবচেয়ে বেশী বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যভিত্ত পরিবারের সদস্যরা।
অনেকেই কোন উপায় না পেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের দপ্তরে কয়েক দফায় বিল পরিশোধ করার জন্য প্রতিদিনই ভিড় জমাচ্ছেন। তবে এই প্রক্রিয়ায়ও গ্রাহককে বিল পরিশোধ করতেই হবে।
প্রখর রৌদের মধ্যে ছাতা টানিয়ে সিলেট নগরীর পূর্ব মিরাবাজারের বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ-২ এর গাছের নীচে বসে থাকতে দেখা যায় ষাটর্ধ্বো আফসর মিয়া। তিনি এসেছেন সিলেট নগরীর রায়নগর দর্জিবন্দ থেকে। দিনমজুর এক ছেলে আর দর্জির দোকানে কাজ করা এদুই সন্তানের আয় দিয়েই কোনভাবে চলছিলো আফসার মিয়ার ‘নুন আনতে,পান্তা ফুরানো সংসার’। কিন্তু হঠাৎ আকাশ চুম্বি বিল পেয়েই হতাশ হয়ে গেলেন তিনি।
বিদ্যুৎ অফিসে কি জন্য এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন- পইতেক (প্রতি মাসে) বিল আয় (আসে) ৬শ-১হাজার এর মাঝে (মধ্যে)। কিন্তু এখন বিল দিসে (দেয়) ৮হাজার টাকা। ইবিল কিলান (কিভাবে) দিমু (দেই)। বাসার মালিকেও জোর দিরা (দিচ্ছেন) বিল দেওয়ার  (দেয়ার) লাগি। আক্ষেপের সাথে তিনি বলেন- ‘বিল দিসে না, দিসে কিয়ামতের লিস্ট’। অর্ধশতাধিক মহিলা-পুরুষ বিল হাতে নিয়ে যেতে দেখা গেছে প্রকৌশলীর দপ্তরে। সবার যেন একই গন্তব্য।
রায়নগর এলাকার আরেক বাসিন্দা শাহীন আহমদ জানান- জুলাই মাসের বিদ্যুৎ বিল এসেছিলো ১ হাজার ৩২ টাকা। আগষ্ট মাসে এসেছে ৬ হাজার ৪৩৫ টাকা। তার প্রশ্ন, এক মাসের ব্যবধানে বিল কিভাবে বেড়ে যায় কয়েকগুণ। শুধু আফসর মিয়া কিংবা শাহীন আহমদ নন অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলের প্রতিকার চেয়ে শত শত গ্রাহক ধরনা দিচ্ছেন সিলেট বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ-২ এ কার্যালয়ে। সরেজমিনে কথা হয় শাহী ঈদগাহ এলাকার হৃদয় মিয়া, রায়নগর এলাকার ব্যবসায়ি পারভেজ, রুবেল হোসেন, শিবগঞ্জ এলাকার রুমনসহ অন্তত ১৫জন বিদ্যুৎত গ্রাহকের সাথে। সবার সাথে বিদ্যুৎ বিলের কাগজ। তাঁদের একই অভিযোগ হঠাৎ করে বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল এসেছে।
সূত্রে জানা যায়- সিলেট নগরীতে বিদ্যুৎ অফিসের মিটার রিডারদের যোগসাজশে অবৈধভাবে চলছে গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কসপ, স্টীল ওয়াকর্সপ, অবৈধ ব্যাটারির রিকশা চার্জের গ্যারেজ ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অবৈধভাবে সংযোগ দিয়ে প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকা আদায় করত মিটার রিডাররা। প্রাইভেট সেক্টরে সরকার যখন বিদ্যুতের বিল ব্যবস্থা হস্তান্তর করেছে তখন বিদ্যুৎ অফিসের অসাধু কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারি সেই অবৈধ সংযোগ গুলোর দায় কৌশলে বৈধ গ্রাহকদের উপরে ফেলে দিচ্ছে যথাযথভাবে।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার জেদান আল মুসা (গণমাধ্যম) জানান- অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল পেয়ে গ্রাহকরা অফিসে বাকবিতণ্ডা করতে পারে সেজন্য বিদ্যুৎ অফিসগুলো থেকে পুলিশের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছিলো। পুলিশ তাদেরকে সহায়তাও দিয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়- এক সময় ঘরে বসে  প্রস্তুত করতেন সিলেটের মিটার রিডাররা। সেই বিল নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে ছিল ক্ষোভ। কিন্তু এখন আর মিটার রিডারদের যুগ নেই। সিলেটের বিদ্যুৎ বিল প্রবেশ করেছে ‘স্ন্যাপশটে’। অর্থাৎ রিডাররা মিটারের কাছে এসে প্রযুক্তির ক্যামেরার মাধ্যমে ‘স্ন্যাপশট’ নিয়ে যান। আর এই স্ন্যাপশটের ওপর ভিত্তি করেই প্রস্তুত করা হচ্ছে বিদ্যুৎ বিল। কিন্তু সিলেটের প্রথম মাসেই কয়েক হাজার গ্রাহক হলেন নতুন প্রযুক্তির বলির পাঠা।
এ অবস্থায় সিলেট বিদ্যুৎ বিভাগের তরফ থেকে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। তারা কিস্তিতে টাকা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিল সংশোধনও করে দিচ্ছেন। সিলেট বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের আওতাধীন ৪টি এলাকা রয়েছে। এই ৪ এলাকা চার ভাগে পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২ ও ৩ এ আওতাধীন পূর্বাঞ্চলের প্রায় অর্ধেক শহরের বিদ্যুৎ বিল এবার বেসরকারি কোম্পানি মেসার্স মুন্সি ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট প্রস্তুত করতে শুরু করেছে।
সিলেট বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রতন কুমার বিশ্বাস জানিয়েছেন, যে বিল আসছে সেটির গ্রাহকেরই বিল। জমানো বিল এক সঙ্গে এসছে। সেটি অনেক গ্রাহকের পরিশোধের ক্ষমতা নেই। এ কারণে কিস্তিতে ও সংশোধন আকারে বিল গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগের রিডাররা ঘরে বসে বিদ্যুৎ বিল প্রস্তুত করার কারণেই এমনটি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তিনি জানিয়েছেন, সিলেটের বিদ্যুৎ বিক্রয় বিতরণ বিভাগ-১ এবং ৪ এ আগামী মাস থেকে স্ন্যাপশটে বিদ্যুৎ বিল প্রস্তুত করা হবে। সেখানেই একই অবস্থা ঘটতে পারে, নাও ঘটতে পারে। তবে আগামী মাস থেকে আবার পূর্বের মতো সহনীয় পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিল আসবে বলে দাবি করেন তিনি।
বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী পারভেজ আহমদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, গ্রাহকদের স্বার্থে কছেশ দফায় বিল পরিশোধ করার জন্য সুবিধা করে দেয়া হচ্ছে। মুনসী ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটকে বিদ্যুতের স্ল্যাপিং ও বিলিংয়ের কাজ দেওয়া হয়েছিলো। তারা ঠিক মত রিডিং দেখে বিল তৈরী না করার কারণে গ্রাহকদের মধ্যে অতিরিক্ত বিলের সমস্যা হচ্ছে। তাছাড়াও অনেকে গ্রাহকের মিটারে পূর্বের অনেক ইউনিট জমে আছে। যার কারণে এক সাথে সব বিল আসার কারণে গ্রাহকরা হতাশ হয়ে গেছেন। (খবর সংবাদদাতার)