নতুন করে পৌর এলাকাসহ বিভিন্ন গ্রাম প¬াবিত ॥ কুলাউড়ার বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি

67

কুলাউড়া থেকে সংবাদদাতা :
অব্যাহত ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে এবং হাকালুকি বুড়িকিয়ারী বাধের ফলে হাওরের পানি নিষ্কাশনের সুযোগ বন্ধ kulaura pic-1 copyথাকায় হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রুপ ধারন করেছে। ২য় দফা বন্যায় বিগত ২০ দিন থেকে উপজেলার হাকালুকি হাওর পারের ভুকশিমইল, ভাটেরা, বরমচাল, জয়চন্ডি, কাদিপুর ও ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ বন্যায় পানিবন্দী হলেও গত সপ্তাহ খানেক থেকে কুলাউড়া শহরের অধিকাংশ এলাকা বিশেষ করে পৌর এলাকার ৫টি ওয়ার্ড বন্যায় প্লাবিত হয়ে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পৌর এলাকার উপজেলা রোড ১৫ দিন থেকে পানির নীচে থাকায় উপজেলায় যাতায়াত করা দু:সাধ্য হয়ে পড়েছে জনসাধারণের। অপর দিকে পৌর এলাকার মাগুরা, টিটিডিসি এলাকা, আহমদাবাদ, উত্তর কুলাউড়া, বিহালা, সোনাপুর, বিছরাকান্দিসহ পৌর এলাকার অধিকাংশ এলাকার মানুষের বাসা বাড়ীতে হাঁটু পানি। ড্রেনের পানি, বাথরুমের পানি সব কিছু একাকার হয়ে মানুষের বাসা বাড়ীতে উঠায় বন্যা দুর্গত মানুষজন রোগ ব্যাধীতে ভুগতে দেখা যায়। বন্যায় এ দুরবস্থায় নিম্ন আয়ের মানুষ না খেয়ে কোন রকমে দিনানিপাত করলেও এসব দুস্থ বন্যায় আক্রান্ত মানুষরা সরকারী কিংবা বেসরকারী কোন ধরনের ত্রান সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেন পৌর কাউন্সিলর মঞ্জুরে আলম চৌধুরী খোকন। তিনি বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান ও প্রশাসনের নাগের ডগায় পৌরসভার ১, ২, ৩, ৪ ও ৮ নং ওয়ার্ডে বন্যায় মানুষজন চরম কষ্টের মধ্যে থাকলেও তারা অন্য জায়গায় ত্রাণ বিতরণ করলেও এসব ওয়ার্ডে কোন ত্রাণ বন্ঠন করা হয়নি। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগ আর অভাবের মধ্যে মানুষ দিনানিপাত করছেন।
এদিকে এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওর পারের কুলাউড়া উপজেলার ৭ ইউনিয়নের লক্ষাধিক বানভাসী মানুষ চলতি বন্যায় চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। ২য় দফা এ বন্যায় হাওর পারের ভুকশিমইল ইউনিয়নের শতভাগ মানুষের বাড়িঘরে পানি উঠায় চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন এ ইউনিয়নের ৪৫ হাজার মানুষ। অন্যদিকে পৌরসভা এলাকার বিহালা, সোনাপুর, বিছরাকান্দি, নতুনপাড়া, মাগুরা এলাকায় মানুষের ঘরে হাঁটু পানি। এছাড়াও বরমচাল, ভাটেরা, কাদিপুর ও জয়চন্ডি ইউনিয়নসহ মোট লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছেন। চলতি সপ্তাহে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় হাওরের পানি বেড়ে এখন শহর প্লাবিত হচ্ছে। ফলে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন বানভাসী মানুষ। বন্যায় আক্রান্ত মানুষরা অনাহারে অর্ধাহারে দিনানিপাত করছেন। আর সাহায্য প্রার্থীদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন।
সরেজমিনে হাওরপারের শতভাগ বন্যায় আক্রান্ত ভুকশিমইল ইউনিয়নে গেলে দেখা যায়, বন্যার পানির নীচে ইউনিয়নের সকল রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা। ঈদের এ মৌসুমে এলাকার মানুষজন শহরের আসতে নিধারুণ দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। রাস্তাঘাট পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় নৌকাযোগে গাদাগাদি করে নারী পুরুষরা শহরে আসতে দেখা যায়। অস্থায়ীভাবে কুলাউড়ার পৌর এলাকার বিহালা গ্রামে এবং ভুকশিমইল গ্রামে নৌকার স্ট্যান্ড স্থাপিত হয়েছে। মানুষজন নৌকাযোগে চলাফেরা করছেন। কিন্তু নৌকা স্বল্পতার কারণে নদী পথেও যোগাযোগ সময় সাপেক্ষে এবং অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হচ্ছে বানভাসী মানুষের। নৌকাযোগে বন্যায় আক্রান্ত ভুকশিমইল, বাদে ভুকশিমইল, চিলারকান্দি, জাবদা, সাদিপুর, মুক্তাজিপুর, কাড়েরাসহ আরও কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি মানুষের বাড়ি ঘরে পানি উঠেছে। কারও বাড়িতে কোমর পানি, আবার কারও বাড়িতে হাঁটু পানি। ঘর থেকে বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। চর্তুদিকে পানি আর পানি। যাদের নৌকা আছে তারা বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন। আর যাদের নৌকা নেই তারা আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের বাড়িতে।
ভুকশিমইল গ্রামের ফয়জুল মিয়া ওরেফে ফয়জুল পীর জানান, তার টিন শেডের ঘরের কোমর পানি। তাই এ ঘরে বসবাস করতে পারায় ঘরের সকল মালামাল ফেলে উঠেছেন আত্মীয়ের বাড়ীতে। কিন্তু আপসোসের সঙ্গে তিনি বলেন, সরকারীভাবে এখনো সাহায্য সহযোগিতা পাইনি। একই গ্রামের সোহাগ, তাহির আলী, জাবেদ, জবলু ও সাজু  জানান, তাদের সকলের বাড়িতে হাঁটু পানি। কারও বাড়িতে কোমর পানি। এ গ্রামে আরও অর্ধশতাধিক মানুষের বাড়িতে পানি উঠেছে। ইউনিয়নের  মেম্বার নজরুল ইসলাম ও সায়রুল ইসলাম জানান, ভুকশিমইল ইউনিয়নের শতভাগ মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছেন। গরীব মানুষের নৌকা না থাকায় বাড়ি ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। এদিকে হাকালুকি হাওর তীরে এদিকে কুলাউড়ায় ৪টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৫৯টি পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
ভুকশিমইল গ্রামের কুমুদিনী বিশ^াস সাংবাদিকদের জানান, ৪/৫ দিন থেকে পানি বন্দী অবস্থায় আছি। ঘরের চুলা পানিতে ডুবে গেছে। তাই রান্না বান্না করতে পারছি না। তাই অনেকটা না খেয়ে আছি। এছাড়াও নুর উদ্দিন,পাখি মিয়া, মনসুর, এমদাদ, জামাল, বিনয় ও হেকিম জানান, তাদের বাড়িঘরে পানি উঠায় তারা বাড়িঘর ছেড়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। আমাদের দেখার কেউ নেই।
এ ব্যাপারে ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির জানান, গত এপ্রিলের আকস্মিক বন্যায় হাকালুকি হাওরে বন্যায় বিশেষ করে ভুকশিমইল ইউনিয়নের হাজার হাজার একর বোরো ধান পচে বিনষ্ট হয়। সে বিপদ কাটতে না কাটতে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে হাকালুকি হাওরে। আর এ বন্যায় হ্ওার পারের ভুকশিমইল ইউনিয়নের শত শত মানুষের বাড়ি ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। কিন্তু সরকারী ত্রাণ একবারেই অপ্রতুল। মানুষের  চাহিদা কোনভাবে মেটানো যাচ্ছে না।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোঃ গোলাম রাব্বি জানান, কুলাউড়া উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৭০/৮০টি গ্রাম এখন পানি বন্দি। তার উপজেলা পরিষদেও বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এ সব ইউনিয়নের প্রায় ২০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা সম্পূর্ণ পানির নিচে। এর ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে গ্রামাঞ্চলের যোগাযোগ। তিনি জানান, কয়েক দফা ত্রান দেয়া হয়েছে এবং এখনও অব্যাহত আছে। চলমান বৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা পানি হাকালুকিতে পড়ে হাকালুকি ক্রমশ ফঁসে উঠতে শুরু করেছে। নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়ে উঁচু অংশেও এখন দেখা দিয়েছে বন্যা।
এদিকে প্রবাসী ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান, উপজেলা চেয়ারম্যান আসম কামরুল ইসলাম এবং কুলাউড়া ব্যবসায়ী কল্যান সমিতির সভাপতি বদরুজ্জামান সজল ও সাধারন সম্পাদক মঈনুল ইসলাম শামীমের নেতৃত্বে ব্যবসায়ী সমিতিসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন ইতিমধ্যে হাকালুকির বন্যা দুর্গত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছে। দুর্গত মানুষরা অবিলম্বে সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি সরকারকে বন্যা দুর্গত মানুষের জন্য ত্রাণ সহায়তা দেওয়া জোর দাবী জানিয়েছেন।