কাজিরবাজার ডেস্ক :
চলতি বছর জানুয়ারি মাস থেকে সদ্য সমাপ্ত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করেছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ওই আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে। ওই আন্দোলনের ধরন দেখে সাধারণের মনে প্রশ্ন জাগে- এর শেষ কোথায়? অবশেষে সরকার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণায় আন্দোলন থামে। নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। তবে ভোটের দিন দুপুরে কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করে দলটি। এ থেকে সাধারণ মানুষের মনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, এবার আরও কঠিন হবে বিএনপির কর্মসূচি। কিন্তু বিএনপি এখনও তা করেনি। এতে এক ধরনের থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে রাজনীতিতে।
এদিকে নীরবতার চাদরে ঢেকে আছে বিএনপি। ভাষা নেই দলটির নেতাদের মুখে। সিটি করপোরেশনের নির্বাচন বর্জন করলেও নেই আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া। নেই করণীয় নিয়ে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা। আপাতত হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না দেশের অন্যতম প্রধান এ রাজনৈতিক দলটি। এতে হতাশার পাশাপাশি ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতাকর্মীরা। বিরাজমান এ পরিস্থিতিতে সবার দৃষ্টি কেন্দ্রের দিকে।
একের পর এক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সময়ক্ষেপণ ছাড়া আপাতত আর যেন কিছুই করার নেই দেশের অন্যতম প্রধান এ রাজনৈতিক দলটির। এ অবস্থায় সবার মনেই প্রশ্ন- কী ভাবছে বিএনপি? দলটির ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা কী? আবার কি নামবে রাজপথের আন্দোলনে?
বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মত, আর ভোট কারচুপি ঠেকাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারা ও কেন্দ্রে এজেন্ট না থাকা সাংগঠনিক দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ। তাই দলে এখনই শুদ্ধি অভিযান জরুরি। আন্দোলন-সংগ্রামে বারবার যারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তাদের বাদ দিয়ে সক্রিয়দের মাধ্যমে নতুন কমিটি গড়তে হবে। সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে সংগঠন পুনর্গঠনের বিকল্প নেই।
বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় সূত্র জানায়, টানা ৩ মাসের দীর্ঘ আন্দোলনে কাক্সিক্ষত সফলতা না আসায় তিন সিটি নির্বাচনেও সাংগঠনিকভাবে দলের দুর্বলতা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এতে ক্ষুব্ধ চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
দলীয় সূত্র জানায়, শিগগির দলের কারাবন্দি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামিনে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফখরুল ইসলাম মুক্তি পাওয়ার পর পরই দ্রুত দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু করবেন। মধ্যবর্তী নির্বাচনের পাশাপাশি আন্দোলনের বিষয়টি মাথায় রেখে চলবে এবারের দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। আন্দোলন ও পুনর্গঠন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, হুট করেই সক্রিয় আন্দোলনে যাওয়া যায় না। বিগত দিনের আমাদের সফলতা, ব্যর্থতা যাচাই-বাছাই ও আলোচনা করে নতুন কর্মসূচি দেয়া হবে। দলের চেয়ারপারসন পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন। তিনি বলেন, গ্রেফতার আতঙ্কে বাড়িঘরে ফিরতে পারছেন না দলের অনেক নেতাকর্মী। তাদের নামে রয়েছে একাধিক মামলা। সক্রিয় কর্মসূচিতে গেলে আবারও মামলার আতঙ্ক থাকে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা ও আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা যাতে ঘরে ফিরতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। এ বিষয়ে আইনজীবীরা কাজ করে যাচ্ছেন।
আন্দোলন করতে গিয়ে জানুয়ারি থেকে ৩ মাস নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। সিটি নির্বাচনকে ঘিরে তারা আবার সরব হয়ে উঠেছেন। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুনভাবে উত্তাপ ছড়িয়েছে। নজিরবিহীন ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে সিটি নির্বাচন বর্জন করার পর নানা মহলে জল্পনা-কল্পনা ছড়াতে থাকে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের দাবি, ভোটের ফল আওয়ামী লীগের ঘরে গেলেও নৈতিক জয়টা বিএনপির ঝুলিতেই জমা হয়ে আছে।
দলীয় সূত্র জানায়, গেল বছর ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিএনপির না নেয়াটা যে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল, সেটা আবারও প্রমাণ হয়েছে সিটি নিবার্চনে। এ নির্বাচনে কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট, সংঘর্ষ ও বিভিন্ন অনিয়মের ভিডিও ফুটেজ এবং আলোকচিত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে। এগুলো বিদেশি রাষ্ট্র ও দূতাবাসগুলোয় সরবরাহ করা হবে। বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপে জানা যায়, দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই আসছে বছরের প্রথম দিকে দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচন চায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। সে লক্ষ্যে দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
দেশে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, সাবিহ উদ্দিন আহমেদসহ আরও কয়েকজন নেতা কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। একই ধরনের কথা উঠে এসেছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুখে। শনিবার রাতে গুলশানে নিজ কার্যালয়ে চারটি আইনজীবী সমিতির নবনির্বাচিত আইনজীবী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে আওয়ামী লীগের অস্তিত্বও থাকত না। এটা তারা বুঝতে পেরেছে। সে কারণেই ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সহিংসতা, জোর-জবরদস্তি, অনিয়ম ও কারচুপির মাধ্যমে ফল দখল করেছে। খালেদা জিয়া বলেন, এত দিন যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে আমাদের সাজেশন দিয়েছিল, এখন তারা বুঝতে পারছে কী কারণে আমরা আওয়ামী লীগের অধীনে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যাইনি। কারণ আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।
সিটি নির্বাচনপরবর্তী কর্মসূচি না দেয়া প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ বলেন, ২৮ এপ্রিল যে সিটি নির্বাচন হয়েছে, তা একটি কারচুপি ও প্রহসনের নির্বাচন। এটি শুধু একটি ত্র“টিপূর্ণ নির্বাচনই নয়, নীল-নকশার নির্বাচনও। এ কলঙ্কিত নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন জেনেশুনে সহযোগিতা করেছে। দেশ-বিদেশে এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপি একটি দায়িত্বশীল ও গণতান্ত্রিক দল, তাই নীরব প্রতিবাদ করেছি। এজন্য সবাই আমাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।