কাজিরবাজার ডেস্ক :
গুলশানের নিজ রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া। গতকাল সকাল থেকে দু’বার বমি করেছেন তিনি। দিনভর ছিল বমি বমি ভাব। চোখ ও নাক দিয়ে ঝরছে পানি। মাথা ব্যথা ও জ্বালা-পোড়া করছে শরীর। শ্বাসকষ্ট ও ঘন ঘন কাশি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে শারীরিক সুস্থতা কামনা করে দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন খালেদা জিয়া। সোমবার বিকালে তার গাড়ি লক্ষ্য করে পুলিশের ছোড়া পিপার স্প্রেতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন তার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল। খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়ার খবরে সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণে তার শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল রাত আটটার দিকে গুলশান কার্যালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন প্রেস সচিব। তিনি বলেন, ৫ই জানুয়ারি নিরাপত্তার নামে ‘অবরুদ্ধ’ খালেদা জিয়ার গাড়ি লক্ষ্য করে পুলিশ ভয়ঙ্কর পিপার স্প্রে করেছিল। এ ঘটনা সারা দেশের মানুষ অবলোকন করেছে। এরপর থেকেই দেশের নানা প্রান্তে থাকা বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন। এরই প্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার নির্দেশক্রমে দেশবাসীকে জানাচ্ছি, তার শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভাল নেই। মারুফ কামাল বলেন, সকাল থেকে দুইবার বমি করেছেন খালেদা জিয়া। এছাড়া, সারাদিন তার বমি বমি ভাব অব্যাহত ছিল। ব্যক্তিগত চিকিৎসক মামুনুর রহমান মামুনসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শক্রমে বিএনপি চেয়ারপারসনকে অক্সিজেন ও নেবুলাইজার দেয়া হচ্ছে। দুইজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার চিকিৎসা করছেন। খালেদা জিয়ার চোখ এবং নাক দিয়ে পানি ঝরছে। তার শরীর জ্বালা-পোড়া করছে। মারুফ কামাল বলেন, এর আগে শিক্ষকদের ওপর এই পিপার স্প্রে করা হয়েছিল। কয়েকজন আহতসহ একজন শিক্ষক পিপার স্প্রের যন্ত্রণায় নিহতও হয়েছিলেন। এর প্রেক্ষিতে এই স্প্রে ব্যবহার না করার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশও আছে। হাইকোর্টের এ নির্দেশ অমান্য করে সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসনকে লক্ষ্য করে পিপার স্প্রে করা হয়েছে। আমরা এর নিন্দা জানাচ্ছি। একইসঙ্গে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতির জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করছি। রাতে গুলশানের অবরুদ্ধ কার্যালয়ের ভেতরে যে ক’জন সাংবাদিক রয়েছেন, তারাই এ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন। বাইরে থেকে কোন সাংবাদিককে পুলিশ প্রবেশ করতে দেয়নি।
অবরুদ্ধ গুলশান কার্যালয়: এদিকে অবরুদ্ধ অবস্থায় নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে টানা তিনদিন পার করলেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া। ৫ই জানুয়ারির সমাবেশকে কেন্দ্র করে ৩রা জানুয়ারি রাত থেকেই নিজের কার্যালয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পূর্বঘোষিত সমাবেশে অংশ নিতে ৫ই জানুয়ারি বিকালে কার্যালয় থেকে বেরুনোর চেষ্টা করলেও বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও গেটের বাইরে বালু, পাথর, ইট ও মাটি ভর্তি ট্রাকের অবস্থান এবং বাইরে থেকে গেটে তালাবদ্ধ থাকায় বের হতে পারেননি তিনি। এমনকি গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময় খালেদা জিয়ার গাড়ি লক্ষ্য করে ছোড়া হয় পিপার স্প্রে। তবে ৫ই জানুয়ারি সন্ধ্যার পর গেটের সামনে থেকে ট্রাক সরিয়ে নেয়া হলেও এখনও ঝুলছে তালা। গেটের দুদিকে ৫০ মিটার দূরে রাস্তায় আড়াআড়ি করে জলকামান রেখে অবরোধ বহাল রেখেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। গুলশানে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে গতকালও দিনভর ছিল পুলিশের কড়া পাহারা এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের ব্যাপক তৎপরতা। গুলশান-২ এ খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনের রাস্তাটিতে যানচলাচল বন্ধ রাখার পাশাপাশি চারদিকে লোকজনের চলাফেরায় আরোপ রয়েছে কড়াকড়ি। সকালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ফের জোরদার করা হয়। বাড়ানো হয় র্যাবের টহল। কার্যালয়ের সামনে ও দুদিকে বেশকিছু পুলিশের পিকআপ অবস্থান করছে। চারপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি প্রতিটি রাস্তার মুখেই অবস্থান করতে দেখা গেছে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের। এ ব্যাপারে গুলশান থানার ওসি (তদন্ত) মো. ফিরোজ বলেন, সকাল থেকে এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। শুধু কার্যালয়ের এলাকাতেই দুইশ’ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ওপরের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল উপস্থিতির কারণে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তার কার্যালয়মুখী হতে পারেননি নেতাকর্মীরা। আর খালেদা জিয়ার সঙ্গে কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল কাইয়ুম, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খানসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। ওদিকে বিকাল তিনটার সময় মাওলানা আবদুর রহিমের নেতৃত্বে তাবলীগ জামাতের একটি প্রতিনিধি দল বিএনপি চেয়ারপারসন অবরুদ্ধ খালেদা জিয়াকে বিশ্ব ইজতেমার দাওয়াত দিতে তার কার্যালয়ে যান। নিজেদের পরিচয় দিয়ে তারা আগমণের কারণ জানালে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা তাদের শরীর তল্লাশি করে ভেতরে প্রবেশ করতে দেন। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। এ সময় প্রতিনিধি দলে তার সঙ্গে ছিলেন মাওলানা আবদুল আউয়াল ও মাওলানা মোয়াজ্জেম হোসেন। পরে কার্যালয় থেকে বেরিয়ে মাওলানা আবদুর রহিম সাংবাদিকদের জানান, আমরা বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি। ওনার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান ও একান্ত সচিব শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস আমাদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া আমাদের দাওয়াত গ্রহণ করছেন। তিনি বলেছেন, প্রতিবারই আমি ইজতেমার মোনাজাতে শরিক হই। এবারও ইচ্ছা আছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি ঠিক থাকলে এবারও আমি মোনাজাতে শরিক হব। ওদিকে পরে ইফতেখার আহমেদের নামে তাবলীগ জামাত পরিচয়ে আরেকটি দল দাওয়াত দিতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে যান। তবে অনুমতি না থাকায় তারা কেউ ভেতরে যেতে পারেননি। পরে ইফতেখার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্ব ইজতেমার দাওয়াত দিতে ও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতেই তারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। কিন্তু অনুমতি না থাকায় তিনি এবং তার দলের কেউ ভেতরে ঢুকতে পারেননি। এদিকে গতকাল বিকেল ৫টায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করতে তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ। সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমি খালেদা জিয়ার সঙ্গে ব্যক্তিগত কুশল ও সহমর্মিতা জানাতে এসেছিলাম। এসে দেখি তিনি খুবই অসুস্থ বোধ করছেন। তার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। তাকে যেভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে তা এখনকার জামানায় রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে অচল। খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোন কর্মসূচির কথা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি তো রাজনীতি করি না। আমার সঙ্গে কোন রাজনৈতিক আলোচনা হয়নি। কর্মসূচির বিষয়ে তিনি তার রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। এ সময় তার সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর রাশেদুল হাসান উপস্থিত ছিলেন। এদিকে পুরান ঢাকার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। দলীয় সূত্র জানায়, অবরুদ্ধ থাকার কারণে তিনি আদালতে যাবার সম্ভাবনা কম। উল্লেখ্য, জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূতির দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ ঘোষণা করে রাজধানীর নয়াপল্টনে সমাবেশের পাশাপাশি সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি নেয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০দল।