কাজিরবাজার ডেস্ক :
চারদিকে উঁচু দেয়াল। রডের তৈরি সেল। এক সেল থেকে আরেক সেলে দেখা বা কথা বলার সুযোগ নেই। সিসি ক্যামেরা, মোবাইল ফোনের জ্যামারসহ রয়েছে নানা প্রযুক্তি। দেশের কারাগারগুলোতে এতসব ব্যবস্থাপনার মধ্যেই বন্দি ভয়ঙ্কর শীর্ষ সন্ত্রাসীরা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কারাগারে, প্রিজনভ্যানে ও আদালতে হাজিরার সময় নানা কৌশলে মুঠোফোন ব্যবহার করছে তারা। অনুসারীদের সাঙ্কেতিক ভাষায় নানা নির্দেশনা দিচ্ছে তারা। অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও খুনের মতো অপরাধও ঘটছে তাদের ইশারায়। কারাগারের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা বা রক্ষীদের ম্যানেজ করে কারাগারে বসেই আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা।
জানা গেছে, কঠোর প্রহরা এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সার্বক্ষণিক সতর্ক পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও নানা কৌশলে কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বাইরে অনুসারীদের সঙ্গে নানা তথ্য আদান-প্রদান করছে। কারাগারের ভেতরে বসেই তারা সন্ত্রাসীদের দিয়ে হত্যা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি করাচ্ছে। লাল তালিকার ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় একের পর এক ঘটছে খুনোখুনি ও চাঁদাবাজি। ধানমন্ডির শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন কারাগারে বসেই সম্প্রতি নির্দেশ দিয়ে হাজারীবাগের চামড়া ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন সাত্তারকে খুন করায়। রোববার তিনি খুন হন। র্যাবের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য। এর আগে ফেব্র“য়ারিতে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত জেএমবির জঙ্গিরা কাশিমপুর কারাগারের হাইসিকিউরিটি সেলে থেকেও বাইরে যোগাযোগ করে জঙ্গি ছিনতাইয়ের নকশা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিল। ফলে ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশ হতাহত করে তিন জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটানো হয়। গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, হত্যাকান্ডের পাশাপাশি জেলখানায় বসেই নিয়ন্ত্রণ করছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি আর অস্ত্র ব্যবসা। ঢাকার অস্ত্র ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মোবাইল ফোনে সীমান্তের অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে বন্দি দাগি সন্ত্রাসীরা।
র্যাবের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, ধানমন্ডির শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন জেলে বসেই চামড়া ব্যবসায়ী ও সাবেক ওয়ার্ড যুবদল সভাপতি সাত্তারের হত্যার ষড়যন্ত্র করে। চার মাস ধরেই ইমন তার ঘনিষ্ঠ হাজারীবাগের ইব্রাহীম খলিল বুলু এবং মাসুদকে জেল থেকে মোবাইল ফোনে পরিকল্পনার দিকনির্দেশনা দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় বুলু, লিঙ্কন ও মাসুদ মিলে সাত্তারের উপর নজরদারি শুরু করে। তারা হত্যাকা-ে কয়েকবার ব্যর্থ হয়। এরপর ইমন জেলখানা থেকে গনি নামে একজন শুটারকে এ কাজের দায়িত্ব দেয়। গনি ও তার সহযোগীরা রোববার সাত্তারকে গুলি করে হত্যা করে।
গোয়েন্দা তথ্যমতে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ছাড়াও দেশের অন্যান্য কারগারে অন্তত এক ডজন শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাগারে বসে হত্যা, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। একাধিক পৃথক মোবাইল থেকে তারা বাইরে থাকা শিষ্যদের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। তারা কৌশল হিসেবে কারাগার থেকে অধিকাংশ সময় বাইরের অনুসারীদের সঙ্গে ছদ্ম ভাষায় কথা বলে। আর তাদের নিদের্শনা অনুযায়ী কাজ করছে সহযোগীরা। কাউকে খুন করছে, আবার কারও বাসা কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গুলি ও ককটেল নিক্ষেপ করছে। দেশের বাইরের সন্ত্রাসীদের সঙ্গেও কারাগার থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা যোগাযোগ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কারা কর্মকর্তা বলেছেন, কারাগারের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও রক্ষীর সহায়তায় মোবাইলগুলো বন্দিদের হাতে পৌঁছে। বিভিন্ন সময় মোবাইল ফোন উদ্ধার হলেও ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা কারারক্ষীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আবার বন্দিরা অনেক সময় কৌশলে মোবাইল ফোন লুকিয়ে রাখে। তারা বিশেষ কায়দায় মোবাইল ফোন কনডমের ভেতর ঢুকিয়ে সুতা দিয়ে বেঁধে টয়লেটের কমোডের মধ্যে রাখে। টেলিভিশন এবং রেডিওর ওপরের অংশ খুলে তার ভেতর রাখা, দেয়াল ছিদ্র করে তার ভেতর মোবাইল রেখে ওপরে কাগজ লাগিয়ে দেয়া, বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী যেমন মুড়ি, বিস্কুটের প্যাকেটের সঙ্গে রাখা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারাগারে সন্ত্রাসীরা যাতে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না পারে, এ লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন কারাগারে জ্যামার লাগানো রয়েছে। চলতি বছরে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলামসহ বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসীর কক্ষে অভিযান চালিয়ে একাধিক মোবাইল সিমকার্ড ও মেমোরি কার্ড উদ্ধার করা হয়। এর আগে নারায়ণগঞ্জ থেকে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) তিন দুর্র্ধষ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার পর কারাগারে বসেই জঙ্গিদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের খবর প্রকাশ পায়। এমনকি প্রিজনভ্যানে বসেও জঙ্গিদের মোবাইল ফোনে কথা বলার নজির আছে।
এ ধরনের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কারাগারের চলমান অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা বিষয় সুরাহার লক্ষ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। এরইমধ্যে ওই কমিটি ২০ দফা সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। কমিটি সুপারিশের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী বা দাগি অপরাধী থেকে শুরু করে বন্দিদের অবৈধভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার ঠেকাতে কারা অভ্যন্তরে মোবাইল ফোন বুথ স্থাপনের কথা বলেছে। এছাড়া ভয়ঙ্কর প্রকৃতির আসামিদের আদালতে আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ঝুঁকি কমাতে আদালত ও কারাগারের মধ্যে আইনসিদ্ধ ভিডিও লিঙ্কেজ স্থাপনেরও সুপারিশ করা হয়েছে।
কারা কর্মকর্তারা বলেছেন, অপরাধী সব জায়গাতেই অপরাধ করার চেষ্টা করে। এ পর্যন্ত যাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কারাবিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে আসার সময় তারা বিভিন্ন কায়দায় লুকিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে আসতে পারে। আবার আদালত চত্বরে চলমান অবস্থায় তারা অনুসারীদের নানা সঙ্কেত দিয়ে থাকে। কিছু অসাধু কারারক্ষীর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করেও তারা মোবাইল আনতে পারে। মোবাইল নেটওয়ার্ক অচল করার জন্য জ্যামার থাকলেও মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক আরও বেশি শক্তিশালী হওয়ায় জ্যামারগুলো কাজ করছে না। তবে চলতি বছর কিছু মোবাইল ফোন কারাগার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ভেতরে যাতে কেউ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
কারা অধিদফতরের মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন বলেন, কারাগারের ভেতরে বসে সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ করার এমন কোনো খবর আমার জানা নেই। তাছাড়া কারাগারে এ ধরনের কোনো সুযোগও নেই। কঠোর নিয়ম ও শৃঙ্খলায় কারাগার পরিচালিত হয়। এছাড়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসীকে রাখা হয় না।