ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বিস্মিত কর্মকর্তা ॥ আলিয়া মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে জামায়াতের গুণকীর্তন

171

cover ground_48_big_45542_0কাজিরবাজার ডেস্ক :
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরে এ দেশে গণহত্যা করার পরও ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের সুযোগে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে আবার তৎপরতা শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকলেও ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার পাশাপাশি রাষ্ট্রযন্ত্রকে নানা কৌশলে ব্যবহার করেছে দলটি। আর এ কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারীদের বিরোধিতার মুখেও টিকে গেছে দলটি।
তবে শীর্ষ নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর দৃশ্যত চাপে পড়েছে দলটি। শক্তি ক্ষয়ের লক্ষণও স্পষ্ট। তবে জামায়াতকে একেবারে নিশ্চিন্ত করতে আদর্শিক লড়াই জরুরি বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এই আদর্শিক লড়াই রাষ্ট্রকেই শুরু করতে হবে বলে মনে করেন তারা। কিন্তু রাষ্ট্র আদর্শিক লড়াই করবে দূরের কথা, উল্টো রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যবহার করেই নিজ আদর্শ প্রচার করছে জামায়াত।
বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার সুযোগে মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রমে নিজেদের নানা কর্মকা-ের প্রচার শুরু করে জামায়াত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসার পরও বিষয়টি রয়ে যায় দৃষ্টির আড়ালে। তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন সম্প্রতি আলিয়া মাদরাসার পাঠ্যক্রম পর্যালোচনা করে যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাকে বিস্ময়কর বলছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাদরাসার পৌরনীতি, ইসলামের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে জামায়াতের নানা কর্মকা-ের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এটি একটি আদর্শিক ইসলামী দল- এমন বক্তব্যও পড়ানো হয় ছাত্রদের। জামায়াতের বিরোধীরা ইসলামের বিরোধী- এমন শিক্ষা কৈশর আসার আগেই মনন মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের।
মাদরাসায় পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে জামায়াতের পক্ষে অবস্থান জোরালো বলে মনে করা হয়। পাঠ্যক্রমে এমন বিষয়গুলো থাকলে এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যবহার করে জামায়াতের আদর্শ প্রচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
পাঠ্যক্রমে যা আছে
আলিয়া মাদরাসার পাঠ্য বইয়ে প্রকাশ্যেই পড়ানো হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর গুণর্কীর্তন ও মওদুদীবাদ। ব্যাংকিং-ব্যবস্থায় ইসলামী ব্যাংকের নানা কার্যক্রমের বিষয়েও উল্লেখ আছে মাদরাসার পাঠ্য বইয়ে। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ মাদরাসা বোর্ডের হেয়ালিপনা ও তদারকির অভাবে বছরে পর বছর একটি নির্দিষ্ট দলের আদর্শ প্রচারে ব্যবহার হচ্ছে মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রম।
মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের আলিম শ্রেণির পাঠ্য বই ‘ইসলামি পৌরনীতি’। এই বইটি একাধিক প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বেসরকারি এসব প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বই ঘেঁটে দেখা গেছে, ইসলামি পৌরনীতির সিলেবাস এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীদের খেলাফত রাষ্ট্র কায়েমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন, জামায়াতে ইসলামী, মওদুদীবাদের প্রকাশ্য প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সুকৌশলে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীকে তুলে ধরা হয়েছে পুরোপুরি ইতিবাচক হিসেবে। গুণগান গাওয়া হয়েছে দলটির ব্যাপারে। এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে একাত্তরে দলটি শত্রুপক্ষের হয়ে অস্ত্র ধরেছিল, সেই কথাও। বরং রাজনীতির পাশাপাশি জামায়াত ‘সমাজসেবা’ করছে বলে দাবি করা হয়েছে সরকারি পাঠ্য বইয়ে। ব্যবহার করা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাভোগ অবস্থায় মারা যাওয়া গোলাম আযমের উদ্ধৃতিও।
এ ছাড়া ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, দ্বিজাতি তত্ত্ব, ইসলামী নেতৃত্বের যোগ্যতা, গুণাবলি, দেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ শ্রেণীর প্রাধান্য, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম রাজনীতি বিলোপের চেষ্টা। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের কল্প-কাহিনিও আছে ‘ইসলামি পৌরনীতি’তে। পাশাপাশি জামায়াতের তহবিলে পরিচালিত রাবেতা আলম আল ইসলামীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, ইসলামী ব্যাংকের কার্যাবলি, ইসলামী শাসনতন্ত্র ইত্যাদিও আছে আলিম শ্রেণির সিলেবাসে। রাষ্ট্র ও সামরিক বাহিনী পরিচালনায় নারীকে একেবারে অক্ষম হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে মাদারাসা বোর্ডের পাঠ্যক্রমে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এভাবে দিনের পর দিন এসবই পড়ানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। যে কারণে মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত একটি ছেলে কিংবা মেয়ে শিক্ষাজীবন থেকেই ভুল তথ্য ও ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছে। ব্যক্তি, সমাজ ও কর্মজীবনেও এই গন্ডি থেকে বের হতে পারে না তারা। যারা নিজে থেকে শেখা ও জানার চেষ্টা করে তারা হয়তো কিছুটা খোলস ছাড়তে পারে। তবে এ সংখ্যা খুবই কম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মুহাম্মদ নাজমুল হক বলেন, ‘একটি গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য মাদরাসা শিক্ষাকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। এর ব্যাপারে আরো আগেই সচেতন হওয়া দরকার ছিল।’ তিনি বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের যদি প্রকৃত সত্য জানতে দেওয়া না হয়, তা হলে তারা তো অন্ধকারেই থেকে যাবে। সব জ্ঞানই তো মানুষের মনে আলো জ্বালাতে পারে না। আলোকিত মানুষ করে তুলতে পারেন না। এ বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। যারা এগুলো পড়ছে তাদের তো কোনো দোষ দেওয়া যাবে না। কিন্তু যাদের কথা ছিল এসব তদারকি করার, তারা কী করছে? তাদের ভূমিকা এত দিন কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার সময় এসেছে।’
আলিয়া মাদরাসা পাঠ্যক্রম পর্যালোচনা করেছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল। তিনি জানান, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড শুধু আলিম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করে থাকে। তারা নিজেরা কোনো বই প্রকাশ করে না। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের পাঠ্যক্রমের আলোকে বাইরের প্রকাশকরা বই প্রকাশ করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেন। বাইরের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের এসব বই পাঠ্যক্রমে অনুযায়ী হয়েছে কি না বা অন্য কোনো বিষয় যোগ করা হয়েছে কি না তা মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে অনুমোদন দেয় কি না তা স্পষ্ট নয়।
তবে মাদরাসার পাঠ বইয়ে স্পষ্ট লেখা থাকে ‘বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে কর্তৃক অনুমোদিত।’ কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে বই প্রকাশের জন্য অনুমোদনপত্রও দিয়েছে মাদরাসা বোর্ড। আবার কোনো কোনো বইয়ে লেখা থাকে, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সর্বশেষ পাঠ্যক্রমে অনুযায়ী রচিত। এসব বইয়ে পাঠ্যক্রমবহির্ভূত যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তা দেখে বোঝা যায় যে, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড সিলেবাস প্রণয়ন ও বই প্রকাশের অনুমোদন দেওয়ার পর তা পাঠ্যক্রম অনুযায়ী হয়েছে কি না তা তদারকি করে না। অথচ বইগুলোতে ঠিকই মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের নাম ব্যবহার করা হয়।
জামায়াতের আদর্শ প্রচারে মাদরাসা বোর্ড : পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে দিনে পর দিন জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে এম সাইফ উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমি বইগুলো পড়েছি। জামায়াত ও মওদুদীবাদের বিষয়গুলো যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা পুরোপুরি দলীয় আদর্শ প্রচারের নগ্ন কৌশল।’ চেয়ারম্যান বলেন, ‘ইসলামি পৌরনীতি বইটি আলিমের পাঠ্যক্রম থেকে আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। বোর্ডের নজরে বিষয়টি আসার পর থেকে মাদরাসার পাঠ্যক্রম আবার পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।’ প্রকাশনা সংস্থার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বইয়ের বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর পরও যেসব জায়গায় বিক্রির অভিযোগ পাওয়া যায় সেখানে অভিযান চালানো হয়। তবে সমস্যা হচ্ছে যারা এসব বই ছেপেছে সেসব প্রকাশনাকে যথাযথ ঠিকানায় গিয়ে পাওয়া যায় না। আমরা একাধিকবার পুলিশ নিয়ে অভিযান চালিয়েছি।’
চারদলীয় জোট আমলে করা এই পাঠ্যক্রম এত দিন কেন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি? জবাবে এ কে এম সাইফ উল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কীভাবে দিনে পর দিন এসব বই পড়ানো হয়েছে, তা চিন্তা কূল পাওয়া যাবে না। আমি তো বোর্ডের দায়িত্ব নিয়েছে বছরখানেক হচ্ছে। আমি এসেই এসব পর্যালোচনা করে এগুলো পরিবর্তন, পরিমার্জনের উদ্যোগ নিয়েছি। আমার আগে যারা ছিলেন তারা কী করেছে, কে জানে।’
মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান জানান, যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এসব বই পাঠ্য করার প্রমাণ পাওয়া যায়, তা হলে তার এমপিও বাতিলের জন্য সব ধরনের সুপারিশ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেন, ‘বর্তমান সরকারের বিভিন্ন খাত থেকে আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থার পেছনে প্রতিবছর কম করে হলেও দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ব্যয় হচ্ছে। সরকারের এই বিপুল অর্থ মূলত জামায়াত ও মওদুদী দর্শনের প্রচারে ব্যবহার হচ্ছে। যদি সত্যিকার অর্থে আলিয়া মাদরাসার মাধ্যমে প্রকৃত আলেম তৈরি করতে হয় তা হলে আলিম থেকে কামিল পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক সরকারিভাবে রচনা ও প্রকাশিত হওয়া দরকার।’