কাজিরবাজার ডেস্ক :
বোরোর ভরা মৌসুমে চালের দামের ঊর্ধ্বগতি রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রীসভা বৈঠকে সংশ্লিষ্টদের প্রতি এই নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে মন্ত্রীসভা বৈঠকে বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হয়। সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রীপরিষদের এই বৈঠক হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রীসভা বৈঠক শেষে সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রীপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, চালের দাম ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে এবং সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চাল মজুদকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেউ অবৈধভাবে চাল মজুদ করলে ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রীসভা বৈঠকে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রীপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ব্রিফিংয়ে আরও জানান, ভোজ্যতেলের পর এবার চালের বাজারেও জোরদার অভিযানে নামছে সরকার।
অভিযোগ আছে, মিলাররা ধান-চাল মজুদ রাখছেন। একইভাবে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও মেমোরেন্ডাম এ্যাসোসিয়েশনের নীতি অনুমোদনের বাইরে গিয়ে ধান-চালের ব্যবসায় নেমেছেন। তারা প্যাকেটজাত আকারে সেগুলো বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। এতে চালের ক্রয়ক্ষমতা ভোক্তার সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এ ধরনের নির্দেশনা এলো।
মন্ত্রীপরিষদ সচিব বলেন, ‘চালের দাম ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে এবং সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সারাদেশে চাল মজুদকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত জোরদার অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, যেসব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান মেমোরেন্ডাম এ্যাসোসিয়েশনের বাইরে গিয়ে অবৈধভাবে চালের ব্যবসায় নেমেছে কিংবা খোলাবাজার থেকে ধান কিনছে তাদের চিহ্নিত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে।’
ব্রিফিংয়ে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, এ বিষয়ে ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যসচিব, খাদ্যসচিব ও কৃষিসচিবকে একসঙ্গে বসে করণীয় নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
মন্ত্রীপরিষদ সচিব বলেন, ‘ভোজ্যতেলের বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকার যেভাবে ড্রাইভ দিয়েছে, ঠিক একই রকমভাবে চালের বাজারে সেই জোরদার ড্রাইভ দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।’
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আজ (সোমবার) পুরো কেবিনেটে আলোচনার বিষয় ছিল চাল এবং তেল। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীপরিষদের সব সদস্যও বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেছেন। পরে মন্ত্রীপরিষদের বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত হয় যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টি সার্ভে করে কার কাছে কী পরিমাণ ধান এবং চাল মজুদ রয়েছে এবং মজুদসীমা কতটা লঙ্ঘন করা হয়েছে সেটি পর্যালোচনা করে দ্রুত এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। অবৈধভাবে চাল মজুদকারীদের ছাড় না দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইতোমধ্যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। রবিবার খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, চালের বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, বাজারে নতুন চাল এখনও আসছে না। বাজারে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে তা গত বছরের পুরাতন চাল। তাহলে নতুন ধান কোথায় যাচ্ছে? রবিবার সচিবালয়ে অফিস কক্ষে ‘বোরো ২০২২ মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ও বাজার মনিটরিং সংক্রান্ত অনলাইন মতবিনিময় সভায়’ তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ধান কিনে মজুদ করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। সবাই প্রতিযোগিতা করে ধান কিনছে, ভাবছে ধান কিনলেই লাভ। অধিকাংশ মিল মালিক বাজার থেকে ধান কিনলেও তারা উৎপাদনে যাচ্ছেন না। বাজারে এখনও নতুন চাল আসছে না। বাজারে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে তা গত বছরের পুরাতন চাল। তাহলে নতুন ধান কোথায় যাচ্ছে? এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা ভাল পরিণতি আনবে না বলে সতর্ক করেন তিনি। এ অবস্থা চলতে দেয়া হবে না। কে কত পরিমাণ ধান কিনছেন ও কে কত পরিমাণ চাল ক্র্যাশিং করে বাজারে ছাড়ছেন তা খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের রিপোর্ট আকারে দিতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন কর্পোরেট হাউস ধান চালের ব্যবসা শুরু করেছে। তারা বাজার থেকে ধান কিনে মজুদ করছে ও প্যাকেটজাত করছে। প্যাকেটজাত চাল বেশি দামে বাজারে বিক্রিও হচ্ছে। এ সময় ধান চালের ব্যবসায় সম্পৃক্ত কর্পোরেট হাউসগুলোর সঙ্গে দ্রুততম সময়ে বৈঠক করতে খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন মন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বোরোর ভরা মৌসুমেও বাজারে নতুন চাল আসছে না। বেরিশভাগ পুরনো চাল দেখা যাচ্ছে। মূলত মজুদদাররা পুরনো চাল ছেড়ে নতুন ধান-চাল মজুদ করছে। পুরনো চালে পোকা হওয়ার ভয়ে এইগুলো বাজারে ছাড়ছে।
বৈঠকে আলোচ্যসূচীর বাইরে আলোচনা বিষয়ে মন্ত্রীপরিষদ সচিব বলেন, বৈঠকে মূলত মার্কেট মেকানিজম নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ছিলেন। এখন ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে কিভাবে পেমেন্টগুলো এনশিওর করতে পারব সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, বিশেষ করে চাল ও তেল নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। এই ভরা মৌসুমে চালের দাম কেন বেশি? গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং কিছু সাজেশন ছিল, এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
বাজার জরিপ করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কেন চালের দাম বাড়বে? তাই কোথায় কে চাল মজুদ করে এবং আমাদের কাছে কিছু তথ্য আছে যে, আমি যে মিল করব বা যে উৎপাদন করব, তার একটা ‘মেমোরেন্ডাম অব এ্যাসোসিয়েশন’ আছে। সেখানে বলা আছে, একজন মিল মালিক কী করতে পারবেন?
খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমাদের মনে হচ্ছে, এমন হতে পারে- কেউ কেউ হয়তো মেমোরেন্ডাম অব এ্যাসোসিয়েশন ভেঙ্গে চালের ব্যবসায় নেমে গেছেন। এ জন্য বাজার শক্তভাবে তদারকি করে যদি কেউ এভাবে গিয়ে থাকে, আবার ধরেন বড় একটা কোম্পানি হাজার হাজার কোটি টাকা আছে, আমি মার্কেটে নেমে এসে ধান ও চাল কিনে ফেললাম, মজুদ করলাম। এগুলো আমি কতদিন রাখতে পারব। এগুলো সুপারভিশন করে কুইকলি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, খাদ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্য সচিব, বাণিজ্য সচিব ও কৃষি সচিবকে দ্রুত বসে মার্কেট সার্ভে করে এ বিষয়গুলো দেখতে বলা হয়েছে। ভরা মৌসুমে কেন চালের দাম এত বেশি থাকবে?
মন্ত্রীপরিষদ সচিব বলেন, কিছুদিন আগে তেলের বিপরীতে যেভাবে ড্রাইভ দেয়া হলো, ওই রকম ড্রাইভ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদি কেউ এভাবে অনুমোদন না নিয়ে চালের ব্যবসা করে বা মজুদ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ দেশেই ‘মেমোরেন্ডাম অব এ্যাসোসিয়েশন’ সুনির্দিষ্ট একটা বিষয়ের ওপর থাকে। কিন্তু আমাদের এখানে দেখা যাচ্ছে, একটা মেমোরেন্ডাম অব এ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে অনেকগুলো ঢুকিয়ে দেয়। তাই এটাও শক্তভাবে দেখতে বলা হয়েছে। কার মেমোরেন্ডাম অব এ্যাসোসিয়েশন ও আর্টিকেল অব এ্যাসোসিয়েশনে কি আছে? সে কি পণ্যের উৎপাদন বা ব্যবসা করবে এবং এর বাইরে যাচ্ছে কি না। প্রয়োজন হলে তাকে সতর্ক করা যেতে পারে।
খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা অন্যান্য দেশ থেকে দ্রুত তথ্যটা নেবে, তারা যে মেমোরেন্ডাম অব এ্যাসোসিয়েশন এবং আর্টিকেল অব এ্যাসোসিয়েশন দেয়, সেটা ব্যবসার কেন্দ্রিক কি না। সেই ব্যবসার বাইরে সে অন্যটা করতে পারে কি না। উন্নত দেশে একটির মেমোরেন্ডাম অব এ্যাসোসিয়েশন দিয়ে আরেক ব্যবসা করা যায় না। এটা হয়তো তারা জানেও না, সেটাও হতে পারে।