সিন্টু রঞ্জন চন্দ
সিলেট ও সুনামগঞ্জে বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি আরও উন্নতি হয়েছে। যদিও এখনো সুরমানদীর পাঁচ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে এই অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড।
এদিকে পরিবার নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষ। সিলেট শহরে সুরমা নদীর পানি কমে বর্তমানে বিপৎসীমার তিন সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে, অর্থাৎ ১০.৭৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন বাসা বাড়ি থেকে নামতে শুরু করেছে পানি। কিছু এলাকায় পানি কমে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে অনেক পরিবার বাড়িতে চলে আসছেন। তবে সিলেট শহর এলাকার ড্রেন, ছড়া, খাল পরিষ্কার না থাকা এবং এক ড্রেনের সাথে অন্য ড্রেনের সংযোগ না থাকায় পানি নামছে না। ড্রেনের ময়লা উপরে উঠে এসে সৃষ্টি হয়েছে দুর্গন্ধময় পরিবেশের। বিভিন্ন বাসা বাড়িতে জমে আছে ময়লা পানি। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বানভাসী মানুষ। আর সরকারী ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রাখলেও কিছু কিছু স্থানে ত্রান পৌঁছলেও অনেক পানিবন্দি বানভাসী মানুষদের মধ্যে এখনও ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি। ফলে হাহাকার করছেন বানভাসী মানুষরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, ১২ ঘণ্টায় সিলেট পয়েন্টে পানি কমেছে ১২ সেন্টিমিটার। এছাড়া, গত ১২ ঘণ্টায় সারি, গোয়াইন, ডাউকির মতো সীমান্ত নদীগুলোর পানি কমেছে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার। কমেছে কুশিয়ারা নদীর পানিও। তবে এখনও জেলার ৯ লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি। প্রায় ৪০০ আশ্রয়কেন্দ্রে ২৫ হাজার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে।
এদিকে সুনামগঞ্জেও বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। বৃহস্পতিবার থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কমছে নদ-নদী ও হাওরের পানি। গেলো ২৪ ঘণ্টায় বিপৎসীমার নিচে নেমেছে সুরমার পানি। বর্তমানে ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে শহরের বেশিরভাগ সড়ক ও ঘরবাড়ি থেকে নেমে গেছে বন্যার পানি। আশ্রয় কেন্দ্রে ছেড়ে নিজ ঘরে ফিরতে শুরু করেছে মানুষজন। এই পরিস্থিতিতে পানিবন্দী মানুষ খাদ্য সংকটে পড়েছেন। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্দি মানুষদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের জন্য নগদ ৫৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। শিশু খাদ্য দেওয়া হয়েছে ১৯ লাখ টাকার ও গোখাদ্য দেওয়া হয়েছে আরও ১৯ লাখ টাকার। বন্যা কবলিত এলাকায় শুকনো খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৭৯৫টি। এছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশনসহ ১৩ উপজেলায় ১১৭৫ মেট্রিক টন চাল দেওয়া হয়েছে।
২১ জুন শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ হতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, সিলেট সদর ও বিশ্বনাথ উপজেলায় ১৫০০ প্যাকেট রান্না করা খাবার এবং ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ হয়েছে।
এদিকে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নেমেছে। তবে ঘরে পানি ঢুকে অনেকের আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন নগরীর বাসিন্দারা। অনেককে রোদে বিভিন্ন আসবাবপত্র শুকাতে দেখা যায়।
নগরীর শাহজালাল উপশহরের বাসিন্দা আমিনা বেগম বলেন, শুক্রবার থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় ঘরের ভেতর থেকে পানি কমেছে। তবে আমাদের ভোগান্তি কমেনি। শুক্রবার থেকে এখন পর্যন্ত শুধু ঘর পরিষ্কার করে যাচ্ছি। ময়লা পানি ঢুকে ঘরের অনেক জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বর্ণী গ্রামের ইউনুস মিয়ার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েসহ পরিবারের ৭ সদস্য তাদের সবাইকে নিয়ে ৪ দিন থেকে রাস্তার পাশে বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে কোনোরকম বসবাস করছেন। তিনি জানান, বন্যার পানিতে ঘরের সব জিনিসপত্র পানি নিয়ে গেছে। শুধু ঘরের চাল আছে, আর ঘরে কিছু নেই। তিনি জানান, সবাইকে নিয়ে কোনো রকমে সাঁতরে এখানে এসে উঠেছেন। মাঝেমধ্যে অনেকে চিড়া-মুড়ি দিয়ে যান সেগুলো খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন জানান, সিলেটে গত ২৪ ঘণ্টায় ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সিলেটে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। ভারতের আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। নতুন করে বৃষ্টিপাত না হলে আশা করা যায় আরও দ্রæত উন্নতি হবে। আমরা বন্যার সার্বিক পরিস্থিতির উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছি। সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধিঃ সিলেটে বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও বন্যাকবলিতদের মধ্যে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। আক্রান্তদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলের পানিতে সৃষ্ট বন্যায় এখন পচা ও জমাট বাঁধা পানি থেকে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। এতে বানভাসিদের দুর্ভোগের শেষ নেই। বন্যা থেকে বাঁচতে কেউ ঘুমানোর খাট চালের সাথে বেধে পানিবন্দি অবস্থায় ঘরের মধ্যে অবস্থান করছেন, আবার অনেকে অন্যের বাসার ছাদে, রাস্তার পাশে, বড় বড় ট্রাকের নিচে কেউবা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন। সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত ত্রাণ দিয়ে টানা কয়েকদিন পানির সঙ্গে লড়াই করে ঠিকে থাকতে হয়েছে পানিবন্দি মানুষের।
নতুন করে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় প্লাবিত হওয়া বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাট থেকে পানি নামতে শুরু করেছে এতে স্থানীয়দের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তবে বানভাসিদের কষ্ট যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। নোংরা ময়লা জমাট বাঁধা পানিতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বাড়ির চারদিকে। পানিতে ভাসছে পলিথিনে ময়লার প্যাকেট, গাছের পাতা ময়লা আবর্জনা পচে তৈরি হচ্ছে তীব্র দুর্গন্ধ। একদিকে সুপেয় খাবার পানি সংকট, অন্যদিকে পানিতে পচা দুর্গন্ধ এতে ভোগান্তির শেষ নেই তাদের। অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন নানা পানিবাহিত রোগে। সুপেয় পানি না থাকায় দৈনন্দিন কাজ এসব নোংরা পচা দুর্গন্ধযুক্ত বন্যার পানির উপর ভরসা করতে হচ্ছে তাদের। এতে চর্মরোগসহ দেখা দিচ্ছে পানিবাহিত নানা রোগ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার বন্যায় প্লাবিত এলাকাগুলোতে পানিবাহিত রোগ বেড়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশু বলে জানা যায়।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগে ৭ লাখ ৭২ হাজারের বেশি শিশু বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম জানান, জেলায় দুইটি মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ও কমিউনিটিতে ৫ হাজার লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হয়েছে। দশ হাজার লিটার পানি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ৫ হাজার জ্যারিকেন বিতরণ করা হয়েছে। ২০০টি হাইজিন কীট বিতরণ করা হয়েছে। ৫ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে।
সিলেট বিভাগীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, বন্যা কবলিত এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি সিলেটের দুইটি জায়গায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে।
হাসপাতালে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে কী পরিমাণ রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন সে তথ্য নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. আনিসুর রহমান। তিনি জানান, পানি কমলেও পানিবাহিত রোগের সংখ্যা বাড়তে পারে, হতে পারে মারাত্মক রোগ। তাই সবাইকে সচেতনতার পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া বন্যা দুর্গত এলাকায় আমাদের ১১৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ঔষধ, খাবার স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হচ্ছে।