বন্যার উচ্চ ঝুঁকি : পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে হবে

12

বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন- ঝড়, জলোচ্ছ¡াস, ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যা, নদীভাঙন এ দেশের নিত্যসঙ্গী। এছাড়া বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর যে পরিবর্তন ঘটছে, তার প্রভাব বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই দৃশ্যমান। জলবায়ুর পরিবর্তন স্পষ্টতই মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে, বিশ্বের বৃহত্তম নদী ভিত্তিক ব-দ্বীপ বেঙ্গল ডেল্টায় অবস্থানের ফলে বাংলাদেশে বন্যার প্রবণতাও বেশি। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। এতে আর্থিক খরচসহ মানবসম্পদের ক্ষতির আশঙ্কাও বাড়ছে। এমতাবস্থায় সম্প্রতি যখন এটা সামনে আসছে যে, দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে- তখন পরিস্থিতি আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য বলেই প্রতীয়মান হয়।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যায় প্রতি বছর গড়ে বাংলাদেশের স্থলভাগের ২০-২৫% এলাকা জলমগ্ন হয়।
অন্যদিকে, চরম বন্যার কারণে দেশের ৫৫-৬০% এলাকা জলমগ্ন হয়। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার এই ঝুঁকি আরও বেড়েছে। ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যার দিক থেকে নেদারল্যান্ড ছাড়া বাংলাদেশের চেয়ে আর কোনো দেশ এগিয়ে নেই। বুধবার লন্ডনের গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৪৫% মানুষ নদীর পানি বেড়ে সৃষ্ট বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে- যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। একইসঙ্গে এটাও আমলে নেওয়া জরুরি- যা প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে। অবস্থানগত কারণে এবং নিচু সমতল ভ‚মির জন্য বাংলাদেশে বন্যার প্রবণতা রয়েছে। এর মধ্যে অতিবৃষ্টির মতো জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বেশ কিছু কারণে বাংলাদেশে বন্যার ঝুঁকি আরও বাড়ছে।
আমরা মনে করি, সামগ্রিক পরিস্থিতি আমলে নিতে হবে। জলায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বন্যার ঝুঁকিসহ সার্বিক বিষয় সামনে রেখে করণীয় নির্ধারণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। এটাও এড়ানো যাবে না, গবেষকদের ধারণা, ক্রমাগত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উচ্চ নির্গমন পরিস্থিতিতে নদী প্রবাহের সর্বোচ্চ মাত্রা গড়ে ৩৬% বাড়তে পারে। কম-নির্গমন পরিস্থিতিতে ১৯৭১-২০০০ সালের তুলনায় ২০৭০-২০৯৯ সালের মধ্যে সেটি ১৬% বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া গুরুত্বসহকারে স্মরণ রাখতে হবে যে, সামগ্রিকভাবে ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। আর জলবায়ু পরিবর্তনের এই ক্ষতিকর প্রভাবের অধিকাংশই বন্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
আমরা মনে করি, একদিকে বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তের কারণে ঝুঁকি বাড়ছে। সঙ্গত কারণেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সতর্ক থাকার পাশাপাশি যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রতিবেদনে এটাও উঠে এসেছে- বাংলাদেশ একটি লো-এমিটিং (কম নির্গমনকারী) দেশ। ২০২১ সালে পৃথিবীতে নির্গত গ্রিন হাউস গ্যাসের মাত্র ০.২৫% বাংলাদেশ থেকে নির্গত হয়েছে। তবে কৃষি এবং জ্বালানি খাত বেশির ভাগ দেশের গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের পেছনে দায়ী। এই দুই খাত থেকে যথাক্রমে ৪৪% ও ৩৯% গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গত হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ থেকে বন্যার ঝুঁকি সবই নির্ভর করে বৈশ্বিক নির্গমন হারের ওপর। বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলোর নির্গমন এক্ষেত্রে বড় ভ‚মিকা রাখে।
আমরা বলতে চাই, যখন এটা আলোচনায় এসেছে, বন্যা মোকাবিলার জন্য প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করা হয় বাঁধ নির্মাণকে। মূলত বিভিন্ন জায়গার বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোকে নিরাপদ রাখতেই এই কাঠামোগত ব্যবস্থার ওপর নজর দেওয়া হয়। কিন্তু বাঁধ নির্মাণ পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশই বন্যার ঝুঁকিতে পড়ে। তখন বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি সামনে রেখে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বোপরি আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতি বছরই বন্যাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। ফলে মনে রাখা দরকার, প্রাকৃতিক দুর্যোগকে রোধ করার কোনো উপায় নেই, কিন্তু প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমানো সম্ভব। যখন দেশে বন্যার উচ্চ ঝুঁকির বিষয়টি সামনে আসছে- তখন সার্বিক বিষয় আমলে নিতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে হবে।