জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্রমান্বয়ে মানুষ বেশি করে সর্বস্ব হারাচ্ছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তার মুখে এসব মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে অত্যন্ত অসহায় জীবনযাপন করে। আর তারাই ক্রমে বেশি করে মানবপাচারকারীদের শিকারে পরিণত হয়। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক সংস্থা (ইউএনওডিসি) এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) যৌথভাবে ‘দ্য গ্লোবাল অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট ট্রাফিকিং ইন পারসন অ্যান্ড দ্য স্মাগলিং মাইগ্র্যান্টস’ শীর্ষক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতেও উঠে এসেছে এমন চিত্র। বৈশ্বিক এই প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সাইক্লোনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকা থেকে এবং সিলেট অঞ্চল থেকে মানুষ বেশি করে মানবপাচারকারীদের কবলে পড়ছে।
কিছুটা ভালো জীবনের প্রত্যাশা সব মানুষেরই থাকে। সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র বিপদগ্রস্ত এসব মানুষকে সেই উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখায়। মিথ্যা প্রলোভন দেয়। একসময় তারা মানবপাচারে জড়িত অপরাধীচক্রের জালে ধরা দেয়। নানা প্রক্রিয়ায় এরা তাদের বিদেশে নিয়ে যায়। নিকট অতীতে দেখা গেছে, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার জঙ্গলে বা লিবিয়ার মরুভূমিতে তাদের আটকে রাখা হয়। নির্যাতন করে তার ভিডিও চিত্র পরিবারকে দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। অনেককে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আবার অনেকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বিক্রি করে দেওয়া হয়। প্রতিবছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়। মানবপাচার এখন শুধু কোনো একটি দেশের সমস্যা নয়, বরং এটি একই সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যা। মানবপাচারকারীদের নেটওয়ার্ক অনেক দেশেই বিস্তৃত থাকে। তাই মানবপাচার রোধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব ধরনের উদ্যোগই বাড়াতে হবে। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় উদ্যোগগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় থাকাও জরুরি। পাচারের শিকার মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির মতো জঘন্য অপরাধকে কঠোরভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক অত্যন্ত শক্তিশালী। অতীতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে পাচারকারীচক্রের অনেক সদস্য গ্রেপ্তারও হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে তাদের বিচারকাজে যথেষ্ট শ্লথগতি রয়েছে। আবার আইনের ফাঁকফোকর থাকায় অনেক অপরাধী পার পেয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মানবপাচার রোধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে যুগোপযোগী আইন করা প্রয়োজন। পাচারকারীচক্রের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা আরো বাড়াতে হবে। দুর্যোগকবলিত এলাকাগুলোর মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি মানবপাচারের বিপদ সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে।