একসঙ্গে একশ’ সেতু উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী ॥ দেশের ইতিহাসে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে আরেকটি মাইলফলক স্পর্শ করল বাংলাদেশ

24
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আওতাধীন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্তৃক সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দেশের ২৫টি জেলায় নবনির্মিত একশত সেতু সুইচ টিপে উদ্বোধন করেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশের ইতিহাসে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে আরেকটি মাইলফলক স্পর্শ করল বাংলাদেশ। স্বাধীনতার গত ৫১ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে এই প্রথম ৮৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ২৫ জেলায় নির্মিত ১০০টি সেতু একসঙ্গে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এই শত সেতু উদ্বোধনের ফলে দেশব্যাপী সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের পথ যেমন উন্মুক্ত হলো, তেমনি ৩৩টি রুট ফেরি পরিষেবা থেকেও মুক্ত হলো, যা সড়ক যোগাযোগকে মসৃণ, দ্রুত, সহজ এবং নিরাপদ করবে।
সারাদেশে একযোগে ১০০টি সেতু উদ্বোধনকে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা ১০০টি সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন দ্রুততর করতে পারব। বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিচ্ছে, তা মোকাবিলায় বেশি বেশি খাদ্য উৎপাদনের তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই আঘাতটা আসবেই। কারণ, বিশ্ব একটি গ্লোবাল ভিলেজ। কাজেই কোনো জায়গায় একটা সমস্যা দেখা দিলে, সেই অভিঘাতটা বাংলাদেশেও এসে পড়ে। পাশাপাশি প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়াতে আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবহারে খুবই সাশ্রয়ী হতে হবে।
উৎসবের আমেজে সোমবার তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি ৮৭৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৫ জেলায় ১০০টি সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার পর প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সেতুগুলো জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সহায়তা করবে। যে কোনো দুর্যোগে মানুষকে সাহায্য করা সহজ হবে, পণ্য পরিবহন এবং বিপণনও দ্রুত ও সহজ হবে।
সেতুগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৬টি, সিলেট বিভাগে ১৭টি, বরিশাল বিভাগে ১৪টি, ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে সাতটি, ময়মনসিংহ বিভাগে ছয়টি এবং রংপুর বিভাগে তিনটি সেতু রয়েছে। নির্মিত এই ১০০টি সেতু রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করেছে। কারণ, তারা ৩৩টি রুট ফেরি পরিষেবা থেকে মুক্ত করেছে, যা সড়ক যোগাযোগকে মসৃণ, দ্রুত, সহজ এবং নিরাপদ করবে।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী সেতুগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। অনুষ্ঠানে সেতুর ওপর একটি ভিডিও-ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়।
এ সময় গণভবনের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সুনামগঞ্জ, বরিশাল, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলাপ্রান্ত যুক্ত ছিল। সুবিধাভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময় করার সময় প্রধানমন্ত্রী চলমান কোভিড-১৯ মহামারী থেকে উদ্ভূত বৈশ্বিক সংকট এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দা এবং বিশ্বে খাদ্যসংকট সৃষ্টির যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে সকলকে সাশ্রয়ী এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার পাশাপাশি সার্বিক উৎপাদন বাড়ানোতে তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
অনেক ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি। সরকার এমনভাবে সেতু, সড়ক ও মহাসড়কগুলো নির্মাণ করছে, যেন শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, আমরা এশিয়ান হাইওয়ে এবং এশিয়ান রেলের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি। কারণ, ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমাদের যোগাযোগ যাতে আরও এগিয়ে যেতে পারে, সেদিকে আমরা বিশষভাবে দৃষ্টি দিয়েছি। আমরা বাংলাদেশটাকে উন্নয়নের জন্য রূপকল্প-২০২১ ঘোষণা দিয়েছিলাম। সেভাবেই কাজ করা হয়েছে।
এ সময় সরকারপ্রধান দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, সেতুগুলো নির্মাণ করে দিলাম। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ, সুন্দরভাবে ব্যবহার করা আপনাদের নিজ নিজ দায়িত্ব। সেতুগুলো নির্মাণের ফলে প্রত্যেকটা অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নতি ঘটবে। তবে করোনাভাইরাস এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিচ্ছে, তাতে আমাদের সবাইকে একটু সতর্ক হতে হবে। সাশ্রয়ী হতে হবে এবং মৃতব্যয়ী হতে হবে।
নিজেদের সঞ্চয় বাড়াতে হবে। তেল-গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের ব্যবহার সীমিত করতে হবে। আর প্রত্যেকটা এলাকায় যেখানে খালি জমি আছে, সেখানে যত বেশি পারবেন, খাদ্য উৎপাদন করবেন। ফল, তরি-তরকারি- যেটাই পারেন, উৎপাদন করবেন। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, ভেড়া যা কিছু পান, সেগুলো পালন করতে হবে। অর্থাৎ নিজেদের উপার্জন নিজেদের করার চেষ্টা করতে হবে। কেননা, বিশ^ব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিচ্ছে, এর ধাক্কা যেন বাংলাদেশকে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, পৃথিবী একটা গ্লোবাল ভিলেজ। তাই সারাবিশ্বে কোনো সমস্যা দেখা দিলে, সেই অভিঘাতটা বাংলাদেশেও আসে। সব জায়গায় দাম বেড়ে যাওয়াতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুবই সাশ্রয়ী হতে হবে। কোনো অপচয় করা যাবে না। আন্তর্জাতিকভাবে আজকে যে খাদ্যঘাটতি দেখা দিচ্ছে, সমস্যা দেখা দিচ্ছে, সেই সমস্যা থেকে বাংলাদেশের মানুষ যেন মুক্ত থাকে- সেটাই আমাদের প্রচেষ্টা। প্রত্যেকটি পরিবারকে তাদের নিজেদের জন্য সেই চেষ্টা করতে হবে।
যে কোনো সংকটে দেশবাসীর পাশে থাকার কথা জানিয়ে দেশবাসীকে উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আছি আপনাদের পাশে, সারা বাংলাদেশের উন্নয়নটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০৪১ ঘোষণা দিয়েছি, ২০৪১ সালে আমরা উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে চাই। বাংলাদেশের কোনো মানুষ গৃহহীন বা ভূমিহীন থাকবে না, সেই নীতিতে আমরা অটল রয়েছি।
অনুষ্ঠানে সরকারপ্রধান বলেন, গত প্রায় ১৪ বছরে আমরা বিভিন্ন মহাসড়কে এক লাখ ১৩ হাজার ৩০৩ মিটার সেতু নির্মাণ/পুনর্নির্মাণ এবং ২১ হাজার ২৬৭ মিটার কালভার্ট নির্মাণ/পুনর্নির্মাণ করেছি। তা ছাড়া বহু সড়ককে তার সরকার মহাসড়কে উন্নীত করেছে যাতে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়। তিনি বলেন, সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু নির্মাণকাজ সমাপ্তকরণসহ খুলনা, পাকশী ও আশুগঞ্জে তিনটি বৃহৎ সেতু নির্মাণ করা হয়, যা মহাসড়ক নেটওয়ার্ককে নিরবচ্ছিন্ন্ন করে তোলে। তার সরকার ’৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসেই সে সময় ১৯ হাজার বৃহৎ, মাঝারি, ছোট সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিল না, সেখানে সেটা করে দিয়েছি। এর জন্য বিভিন্ন জেলা যুক্ত করে আজ একসঙ্গে ১০০টি সেতুর উদ্বোধন করতে পারছি। কেননা, দুর্গম এলাকাতে পর্যন্ত আমরা ব্রডব্যান্ড এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি বলেন, এটা একটা আনন্দের বিষয়ও। কারণ, একসঙ্গে শত সেতু উদ্বোধন ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি। সারাদেশে কানেকটিভি বাড়ানোতে তার সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, সারাদেশে, সড়ক, নৌ এবং আকাশপথে যোগাযোগের পদক্ষেপ তার সরকার নিয়েছে।
‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশে আর কোনো অভাব হয়নি’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ফলে পার্বত্য অঞ্চলেও উন্নয়ন হচ্ছে। সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নয়ন হচ্ছে। সরকার দেশের যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি তৃণমূলের মানুষের জন্য দেশের যে উন্নয়ন করা হয়েছে, তার সুফল পাচ্ছে দেশের মানুষ এবং সরকার কাজ করছে বলেই মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আবারো বলেন, দেশের উন্নয়নের যে ধারাটা আমরা সৃষ্টি করেছি, সেটা ধরে রাখতে উৎপাদন বাড়ান। দেশে চলমান ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়েও অনুষ্ঠানে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যে সব জায়গায় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা গেছে, সে সব এলাকায় ঘরবাড়ি এবং চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন এবং মশারি টানিয়ে ঘুমাতে যান।