কাজিরবাজার ডেস্ক :
রেলসেবায় আসছে নতুনত্ব। বদলে যাচ্ছে রেলের একশ’ বছরের আগের আইন। সংযোজন করা হচ্ছে নতুন ধারা ও উপধারা। নতুন আইনে দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ। যা আগে ছিল ১০ হাজার টাকা। এছাড়া রেলসেবায় বাধা প্রদানসহ নানা বিষয়ে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে ১৩২ বছরের পুরনো আইন সংশোধন করে খসড়া প্রণয়ন করেছে রেলওয়ে। ইতোমধ্যে আইনটির খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেয়া হয়েছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোঃ হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘রেলওয়ের আইনটি ব্রিটিশ আমলে ইংরেজীতে তৈরি করা হয়। এটি এখন বাংলায় অনুবাদ করে কিছু ধারা ও উপধারা সংযোজন করে সংশোধন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আইনটির খসড়া প্রণয়ন করে মন্ত্রিপরিষদে জমা দেয়া হয়েছে। এরপর এটি আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের মাধ্যমে কেবিনেটে চূড়ান্ত অনুমোদনের পর জাতীয় সংসদে পাস হবে।’
জানা গেছে, বাংলাদেশ অঞ্চলে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর। সে সময় চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতী পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার রেলপথ চালু করা হয়। ১৮৮৫ সালে চালু করা হয় নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা পর্যন্ত রেলপথ। পরের বছর তা জয়দেবপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়। আর ১৮৯৫ সালে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত ১৪৯ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার এবং লাকসাম থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ৫০ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার লাইন দুটি চালু করা হয়।
এভাবে রেলওয়ে সেবা সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে এ অঞ্চলে। তাই এ সেবাকে একটি কাঠামোতে আনা ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠায় ১৮৯০ সালে ‘রেলওয়েজ এ্যাক্ট ১৮৯০’ প্রণয়ন করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। ১৩২ বছরের সেই আইন দিয়েই এখনও পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যদিও স্বাধীনতার পর আইনটির কয়েকটি ধারায় সংশোধনী আনা হয়। এতে বিভিন্ন বিষয়ে জরিমানা ও রেল দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়ানো হয়।
তবে শতবর্ষের আগের সেই পুরাতন আইন দিয়েই চলছে রেলওয়ে। অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যার মুখে পড়তে হয়। সম্প্রতি রেলওয়েতে নতুন নতুন বিষয় যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া জরিমানা ও ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বর্তমান সময়ের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৩২ বছরের পুরনো আইনটি আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী মোঃ নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলের আইনটি কিছু সংযোজন ও বিয়োজন করে খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছোড়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এটা একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আগে এত গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এখন তা দ-বিধির মাধ্যমে শাস্তি বিধান যুক্ত করা হয়েছে। খসড়া আইনটি বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রয়েছে। এরপর সচিব কমিটি ও মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে পাস হবে।’
কি আছে নতুন আইনে : একটি বেসরকারী পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আইনটির একটি খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে রেল পরিচালনায় বিভিন্ন নতুন বিষয় যুক্ত করার পাশাপাশি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত যাত্রীদের ক্ষতিপূরণ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি বীমা তহবিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া রেলসেবায় বাধা প্রদানসহ নানা বিষয়ে শাস্তির মাত্রা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার বা রেলওয়ে প্রশাসন ‘বীমা তহবিল’ নামে একটি তহবিল গঠন করতে পারবে। বীমা তহবিলের উৎস হবে আইনের ৪২খ ও ৬১ ধারার অধীনে প্রাপ্ত বা আদায়কৃত চার্জ, সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুদান, রেলওয়ে প্রশাসন থেকে প্রদত্ত মঞ্জুরি ও অন্য কোন বৈধ উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ বীমা তহবিলের পৃথক হিসাব কোডে জমা ও সংরক্ষণ করা হবে। আর আইনের ৮২ক ও উপ-ধারা (২)-এর অধীনে রেলওয়ে প্রশাসন কর্তৃক প্রদেয় ক্ষতিপূরণ বীমা তহবিল থেকে পরিশোধ করা হবে।
ট্রেনে ভ্রমণের জন্য কারও নামে টিকেট কাটা হলে তা হস্তান্তর না করার জন্য আইনটিতে নতুন আরেকটি ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি কোন নির্দিষ্ট আসন বা বার্থের টিকিট কাটলে তাতেই ভ্রমণের শর্ত যুক্ত হবে। এক্ষেত্রে চাইলেই যাত্রী আসন বা বার্থ পরিবর্তন করা যাবে না। তবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন রেল কর্মচারী যাত্রীর অনুরোধে তার আসন পরিবর্তনের অনুমোদন দিতে পারবেন।
এ বিষয়ে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সরদার শাহদাত আলী বলেন, ‘পুরাতন আইন সংশোধন করে নতুন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে আইনটির খসড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে কিছু সংশোধন করা হয়েছে।’ নতুন আইনে দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ ও চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের শাস্তি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের সুপারিশ : ট্রেন দুর্ঘটনায় কোন যাত্রী মারা গেলে এবং তার সঙ্গে ট্রেনের টিকিট থাকলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের বিধান রয়েছে বিদ্যমান আইনে। নতুন আইনে এক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। আর ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত যাত্রীদের নির্দিষ্ট কোন ক্ষতিপূরণের কথা বিদ্যমান আইনে উল্লেখ নেই। তবে নতুন আইনে অঙ্গহানির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা, স্থায়ী অন্ধত্বের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা, স্থায়ী শ্রবণশক্তি লোপের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ও হাড় ভাঙ্গা বা কোন হাড়ের অবস্থানচ্যুতি বা দাঁত পড়ে গেলে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে।
এর বাইরে বিভিন্ন শাস্তির মাত্রাও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে আইনটির খসড়ায়। এর মধ্যে অকারণে এ্যালার্ম চেন টেনে ট্রেন থামালে অনুর্ধ এক বছরের কারাদন্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে হবে। বর্তমানে সেক্ষেত্রে এক মাসের কারাদন্ড বা ২০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য স্থানে ট্রেন থামালে অনধিক ৫০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে, বর্তমানে যা ৫০ টাকা।
টিকেট ছাড়া ভ্রমণ করলে জেল-জরিমানার বিধান : প্রতারণার উদ্দেশ্যে টিকেট বা পাস ছাড়া ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনধিক তিন মাসের কারাদন্ড বা দুই হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয়দন্ডে দন্ডিত হতে হবে। তবে প্রতারণার অভিপ্রায় না থাকলে যে দূরত্বে ভ্রমণ করা হবে তার ভাড়া ও অতিরিক্ত চার্জ বা জরিমানা দিতে হবে। আর ট্রেনের ভেতর কোন যাত্রী ধূমপান করলে ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে, বর্তমানে যা ২০ টাকা।
এর বাইরেও নতুন আইনে কিছু নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে ট্রেনে নারীদের জন্য কমপক্ষে একটি কোচ রিজার্ভ রাখার শর্ত রয়েছে। কোন ট্রেন ৫০ মাইলের বেশি দূরত্বে চলাচল করলে এ শর্ত প্রযোজ্য। তবে নতুন আইনে তা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও ভূমি) মোঃ ফারুকুজ্জামান বলেন, ‘রেলওয়ে পরিচালনার আইনটি অনেক পুরনো। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত সে আইনের অনেক বিষয় বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রযোজ্য নয়। আবার নতুন নতুন বিষয়ও যুক্ত হয়েছে রেলসেবায়। তাই আইনটি সংশোধন করে খসড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। এরপর যাচাই-বাছাই করে এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে।’ সেখান থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে। সর্বশেষ জাতীয় সংসদের মাধ্যমে আইন পাস হবে বলে জানান তিনি।