মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের ২৩২টি চা-বাগানে চলমান ধর্মঘট নিরসনে চা-শ্রমিক নেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ শ্রম অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী। তবে আজ (১৭ আগষ্ট) বুধবার ঢাকায় শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে মালিকপক্ষের এবং ২৩ আগষ্ট ঢাকায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ে কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলস্থ শ্রম অধিদপ্তরের কনফারেন্স রুমে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক চলে টানা তিনঘন্টা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দিন, হবিগঞ্জের এডিশন্যাল এসপি (এডমিন) শৈলন চাকমা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. সাদিকুর রহমান, মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার, শ্রীমঙ্গলস্থ বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুর রহমানসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা পরাগ বারই, সভাপতি মাখল লাল কর্মকার, সহ-সভাপতি পঙ্কজ কন্দ, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল, সাংগঠনিক সম্পাদক ও বালিশিরা ভ্যালির সভাপতি বিজয় হাজরা, অর্থ সম্পাদক পরেশ কালেন্দি, সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা, মনু ও ধলাই ভ্যালির সভাপতি ধনা বাউরী, জুড়ী ভ্যালীর সভাপতি কমল চন্দ্র বোনার্জীসহ সাতটি ভ্যালির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকগণ উপস্থিত ছিলেন।
অপরদিকে বৈঠকচলাকালে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ প্রতিটি চা-বাগানেই শ্রমিকেরা ধর্মঘটের অংশ হিসেবে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করছেন।
এদিকে মঙ্গলবার সকালে ৩শ’ টাকা মজুরি দাবিতে পূর্বঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী শ্রীমঙ্গল ভাড়াউড়া চা বাগানের চা শ্রমিকরা ফিনলে চা কারখানার সামনে বিক্ষোভ করেছে। সেখানো হাজার হাজার শ্রমিকরা জড়ো হন। একই সাথে সারাদেশের ২৪১টি ফাঁড়ি চা বাগানের মধ্যে ২৩২টি চা বাগানের শ্রমিকেরা ধর্মঘট পালন করছে। এ সময় চা-বাগানের সড়কগুলোয় অবস্থান নিয়ে সড়ক বন্ধ করে দেন তাঁরা। এ সময় চা শ্রকিদের উদ্দেশ্য করে নেতারা বলেন, ‘আমরা সমঝোতা বৈঠকে যাচ্ছি। আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যান।’
চুনারুঘাট চা বাগানের নারী শ্রমিক নেত্রী খায়রুন আক্তার বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করতে চাই না, কারণ মালিকপক্ষ আন্দোলন করতে বাধ্য করছে। ৩শ’ টাকা মজুরি দাবি মেনে নিলে আন্দোলন ছেড়ে দিব।’
চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বলেন, ‘ বাগানের শ্রমিকেরা ঘরে বসে নাই। তাঁরা সবাই ফ্যাক্টরীর সামনে জড়ো হয়ে আন্দোলন করছে। আমরা সুন্দর সমাধান চাই। আন্দোলন চলমান রেখে বৈঠকও চলবে। মানসম্মত মজুরি পেলে আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করব।’
বাংলাদেশে চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দের ডিজির আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় ডিজি মহোদয় প্রস্তাব দিয়েছেন আপনারা আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য। আগামী ২৩ তারিখ ত্রিপাক্ষিক আলোচনা সাপেক্ষে বিষয়টি সমাধান করবো। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। আন্দোলন চলমান রেখেই আলোচনা চলবে। সিদ্ধান্ত হলে আন্দোলন প্রত্যাহার করবো। কারণ সারা বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি দাবিতে ফুঁসে উঠেছে। এখন তাদেরকে থামানোর কোনো সুযোগ নাই। তারপরও আমরা শ্রমিকদের বলেছি, শোকের মাসে আমরা রাজপথে আন্দোলন করবো না, বাগানে বাগানে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করা হবে। বুধবার মালিক পক্ষের সাথে আমাদের শ্রমিক নেতার বৈঠক হবে এবং আগামী ২৩ আগষ্ট ঢাকায় ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে অনুষ্ঠিত হবে। সৈই বেঠকে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে মানসম্মত মজুরি পাই এই সিদ্ধান্ত আমরা প্রত্যাশা করি। যদিও ওই দিন কোনো সিদ্ধান্ত না হয় আমাদের মৃত্যু ছাড়া কিছুই নাই। রাজপথে নেমেছে আমরা জীবন দিতে বাধ্য থাকিবো।”
বাংলাদেশ শ্রম অধিদপ্তরের মহা পরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী বলেন, বুধবার ঢাকায় মালিকপক্ষ ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে সমস্ত শ্রমিক নেতৃবৃন্দরা ছিলেন। তাদের বক্তব্য শুনে রেকর্ড রেখেছি। আমরা বলেছি যে, দেশের স্বার্থে, চা শিল্পের স্বার্থে, শ্রমিকদের স্বার্থে, ধর্মঘট প্রত্যাহার করার আহবান জানিয়েছি। আমরা আগামী ২৩ তারিখ যে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হবে, সেখানে শ্রম মন্ত্রী ও সচিব বৈঠকে থাকবেন এবং মালিক প্রতিনিধি ও শ্রমিক প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। সেই বৈঠকে সবকিছু নিয়ে আলোচনা হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা তাদেরকে অনুরোধ করছি চায়ের ভরা মৌসুমে ধর্মঘট প্রত্যাহার করুন, প্রয়োজনে আমরা বারবার বসে আলোচনা করবো। তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছে, আন্দোলন চলমান রেখেই বেঠক নিষ্পত্তি করতে চায় চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দরা।’
ফিনলে টি কোম্পানির চীফ অপারেটিং অফিসার তাহসীন আহমেদ চৌধুরী বলেন, চায়ের ভরা মৌসুম। প্রতিদিন চার লাখ কেজি কাচা চা পাতা উত্তোলন হতো। শ্রমিক আন্দোলনের কারণে প্রতিদিন দুই কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
চা শ্রমিকদের দাবি:
চা বোর্ডে তথ্য দেশে ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে। আর দেশের ফাঁড়ি বাগান মিলে ২৪১টির চা বাগানে বসবাসরত প্রায় ১০ লক্ষ চা শ্রমিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। তাঁরা বলেন, গত ১৯ মাস ধরে চুক্তি নবায়ন নিয়ে মালিক পক্ষের সাথে শ্রমিক নেতাদের দর কষাকষি চলছে। মালিক পক্ষ শ্রমিকদের মজুরী ১২০ টাকা থেকে ১৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩৪ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। যা শ্রমিকরা কোনো ভাবেই মানছে না। এতে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান ভরা মৌসুমে চা শিল্পে অস্থিরতা তাদের মোটেও কাম্য নয়। গত ১ আগষ্ট ইউনিয়ন কার্যকরি কমিটি ও ভ্যালি কমিটি সমূহের যৌথ সভায় সাত কর্মদিবসের মধ্যে মজুরী বৃদ্ধির বিষয়টি শ্রমিকদের কাছে গ্রহণ যোগ্য সুরাহা ব্যবস্থা না হলেও শ্রমিকদের সাথে নিয়ে ন্যায় সংগত মজুরি আদায়ের জন্য নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তাই বর্তমানে চা শিল্পের এই অচলাবস্থা নিরসনে তারা প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য কামনা করেন তাঁরা।