কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে (ডিপিই) কর্মকর্তা ১৩৭ জন। ১৯ জন সংযুক্ত হিসেবে। এদের মধ্যে ৫০ জন একই দপ্তরে দীর্ঘদিন। সরকারি চাকরির বিধান অনুযায়ী তিন বছর পর পর বদলির নিয়ম থাকলেও এখানে তা হয় না। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক বলছেন, প্রতিষ্ঠান চালাতে পুরোনো লোক দরকার হয়, এজন্য তাদের বদলি করা হয় না। আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের বক্তব্য, বিষয়টি আমার নজরে রয়েছে। আদালতে মামলা থাকায় বদলি করাও সম্ভব হচ্ছে না।
সরকারি চাকরির বিধানের বিষয়ে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের ২০১৫ সালের ৮ জুলাইয়ের জারি করা এক পরিপত্র অনুসারে, একই পদে তিন বছরের বেশি সময় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বাস্তব অবস্থাভেদে অন্যত্র বদলি করতে হবে। দুর্গম অথবা প্রতিকূল যোগাযোগ ব্যবস্থাসম্পন্ন এলাকার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর মেয়াদ দুই বছর হলেও তাকে অন্যত্র বদলি করা যেতে পারে।
অর্থাৎ সরকারি চাকরির বিধানে কর্মকর্তাদের দুই-তিন বছর পর বদলির কথা থাকলেও ডিপিইতে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না।
ডিপিই থেকে জানা যায়, অধিদপ্তরের বিভিন্ন শাখায় ১৩৭ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫০ জন বছরের পর বছর একই স্থানে থাকলেও তাদের বদলি করা হচ্ছে না।
জানতে চাইলে ডিপিইর মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, প্রতিষ্ঠান চালাতে পুরোনো জনবল প্রয়োজন রয়েছে। সে কারণে পুরোনো দক্ষ কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে।
সরকারি চাকরি বিধান অনুযায়ী দুই-তিন বছর পর কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়টি মানা হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরোনো সবাইকে বদলি করলে আমি তো কাজ করতে পারবো না। তবে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের বদলিসহ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ডিপিইর প্রয়োজনীয় আসবাবসহ প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় সংক্রান্ত কাজ করে প্রকিউরমেন্ট বিভাগ। এ বিভাগে সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. সোহাগ মিয়া ২০০৬ সালের মে মাস থেকে একই চেয়ারে রয়েছেন। এ বিভাগের আরেক সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আবু ইয়াছিন ২০০৮ সাল, একই পদে বিপ্লবী বিশ্বাস আছেন ২০০৯ সাল থেকে। এই তিনজনের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
১৯৯৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টানা থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে মহাপরিচালকের দপ্তরে প্রশাসনিক কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) মো. রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত মহাপরিচালকের দপ্তরে সহকারী শিক্ষক কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) মো. মোস্তফা ফারুক খান, অর্থ উন্নয়ন বিভাগের সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. রাসেল মিয়া, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের উপ-পরিচালক ড. নুরুল আমীন চৌধুরী, পলিসি ও অপারেশনের উপ-পরিচালক মো. মহিউদ্দিন তালুকদার, প্রশাসন বিভাগের উপ-পরিচালক মো. বাহারুল ইসলাম, প্রশাসন বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. জুলফিকার হারুন, একই পদে আব্দুল আলীম, অর্থ বিভাগে মো. নুরুল ইসলাম, অর্থ বিভাগে (অডিট) সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন, শিক্ষা কর্মকর্তা মোছাম্মদ রোখসানা হায়দার, রুমানা সাবির, জান্নাতুল ফেরদৌস (সংযুক্ত), মো. মোশারফ হোসেন (সাময়িক বরখাস্ত) ও শাহ মো. মামুন অর রশীদ রয়েছেন।
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে অনেকে দীর্ঘদিন ধরে একই স্থানে থাকার বিষয়টি আমার নজরে রয়েছে। আদালতে মামলা থাকায় নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তাদের বদলি করাও সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, যারা সৎভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করেন তারা এক স্থানে যত বেশিদিন থাকবেন প্রতিষ্ঠানের জন্য সেটি মঙ্গল। তবে কেউ যদি অনিয়মে লিপ্ত হয় সেটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর। বিষয়টি নতুনভাবে খতিয়ে দেখা হবে।
পদোন্নতি জটিলতা ও মামলাজনিত কারণে ডিপিইতে চাইলেও কর্মকর্তা বদলি করা যায় না। সে কারণে কেউ কেউ অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করেন এ প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ।
তিনি বলেন, যারা এক পদে দীর্ঘদিন থাকছেন তারা অভিজ্ঞ হলেও নিজের দায়িত্ব পালনে অবহেলা তৈরি হয়। সে কারণে সেবা ও জরুরি কাজ সম্পন্ন করতে বিলম্ব হয়। কারও অনেক উঁচু পর্যায়ে হাত থাকায় তাদের বদলি করা সম্ভব হয় না। নানাভাবে তদবির করে সে প্রক্রিয়া বন্ধ করার চেষ্টা করেন তারা। সে কারণে প্রধানের চেয়ারে থেকেও অনেক কিছু চাইলে করা সম্ভব হয় না।
‘পুরোনোদের মধ্যে কেউ কেউ দায়িত্বশীল আচরণ করছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ নেই। তবে কোনো দপ্তরের একজন কর্মকর্তা অনিয়মে যুক্ত হলে সেই দপ্তরের কাজ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। ধীরে ধীরে অন্যরাও অনিয়ম করতে শুরু করে। তাই নিয়ম অনুযায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা বদলির বিষয়টি নিয়মিত চর্চা থাকলে সঠিক সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।’
এ বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তারা এক স্থানে বেশিদিন থাকলে তারা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, এটি বিভিন্ন গবেষণায় ও গণমাধ্যমের সংবাদে বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত। যারা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন, তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে সেবায় নানান প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। সে কারণে সরকারি চাকরিতে বদলি প্রক্রিয়া রাখা হয়েছে। সেটি কেন হচ্ছে না তা খতিয়ে দেখা দরকার। যারা বদলি করবেন তারাও যোগসাজশের মাধ্যমে এক ধরনের সিন্ডিকেট তৈরি করে কমিশন আদায় করছেন কি না সেটিও দেখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, মামলা ও পদোন্নতি জটিলতা দেখিয়ে কাউকে চিরদিন রাখা হবে সেটি হতে পারে না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনে বিষয়গুলো উঠে এসেছে। তাই আমরা বিশ্বাস করি মন্ত্রণালয়ের নজরে এসব বিষয় রয়েছে। তাদের উচিত এসবের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের জবাবদিহির মধ্যে আনা। সেটি করতে না পারলে তা নিয়ন্ত্রণকারীদের সদিচ্ছার ঘাটতি বলে প্রমাণ হবে।