কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেখতে না দেখতে অর্ধেক মাস পার করে এলাম। রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তাবাহী মাহে রমজানুল মোবারকের আজ ১৫তম দিবস। অন্যান্য এগারো মাসের দিন ও রাতসমূহের যে বৈশিষ্ট্য তা থেকে একটু সুন্দর সুশৃঙ্খল এ মাসের দিবানিশি। এখন ঘুম ভাঙ্গে না অন্যান্য এগারো মাসের মতো ফজরের আজানের মাধ্যমে। বরং এরও বহু আগে সেহেরির ঘোষণা ধ্বনি মুমিনকে উতলা করে তোলে তাহাজ্জুদ ও সেহেরি গ্রহণের জন্য। সারাদিন আর যেন কোন পানাহারের আগ্রহ নেই, ফুরসত নেই। আছে একাধারে কর্মব্যস্ততা আর সালাত তিলাওয়াতের প্রেমময় টান। সন্ধ্যায় শুরু হয় ইফতার গ্রহণের এক মোহনীয় উৎসব। আর একই সঙ্গে পাশের মসজিদে গিয়ে খতমে তারাবিহ শোনার ব্যাকুলতা। রোজা ফরজ ইবাদত। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র মাহে রমজানে মুসলমানদের ওপর সিয়াম সাধনা ফরজ করেছেন। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা আমাদের একজন সংযত ও আদর্শবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে এবং একই সঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রিয়ভাজন হওয়ার সুযোগ এনে দেয়।
‘রমজান’ শব্দটি আরবি ‘রমজ’ শব্দ হতে নির্গত। এর অর্থ দহন প্রক্রিয়া। আর সাওম বা সিয়াম মানে বিরত থাকা, সংযত হওয়া ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়তে সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির নিয়তে যাবতীয় পানাহার ও কামনা বাসনা হতে মুক্ত থাকার নাম সাওম বা রোজা। পবিত্র মাহে রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার দহন প্রক্রিয়ার ফলে মানুষের মন ও দেহে লুকায়িত আমিত্ব, পশুত্বের যে সব খারাপ গুণাবলী বাসা বেঁধে থাকে তা বিদূরিত হয়।
বলা বাহুল্য, রোজা বা উপবাস দহন প্রক্রিয়া সর্বকালে সর্বযুগে মানুষের দৈহিক-মানসিক ও আত্মিক সুস্থতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন হিসেবে প্রতিপন্ন হয়ে আসছে। যে কোন ধর্মের অনুশাসনে আমরা নানা নিয়মে উপবাসব্রত পালনের ঐতিহ্য লক্ষ করি। যুগে যুগে মহামনীষীরা সিয়াম সাধনার নানা ব্যাখ্যা ও উপকারিতা ব্যক্ত করেছেন এবং প্রকাশ করেছেন সিয়ামের উদার ও কল্যাণময় দৃষ্টিভঙ্গি।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও মুসলিম মনীষী আল্লামা ইমাম গাজ্জালী (রহ)-এর সিয়াম সাধনার ব্যাখ্যা বেশ অনুধাবনযোগ্য। তিনি তার অমর গ্রন্থ ‘কিমিয়ায়ে সা’আদাত’ এ রোজাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। এক. সাধারণ লোকের রোজা, দুই. উচ্চ শ্রেণীর মহাপুরুষের রোজা এবং তিন. মধ্যম শ্রেণীর রোজা।
ইতোপূর্বে রোজার সংজ্ঞায় যা বর্ণিত হয়েছে তা সাধারণ মানুষের রোজা। পানাহার, জৈবিক চাহিদা সম্ভোগ ইত্যাদি হতে বিরত থাকলেই সাধারণ লোকদের পালনীয় কর্তব্য শেষ হয়ে যায়। আর সাধক আউলিয়া-বুজুর্গদের রোজা হলো সর্বোচ্চ স্তরের রোজা পালন বা সিয়াম সাধনা। এই শ্রেণীর রোজায় রোজাদারের অন্তর সর্বদা আল্লাহ তায়ালার চিন্তায়ই নিমগ্ন রাখতে হয় এবং আল্লাহ ভিন্ন অন্যান্য যাবতীয় পদার্থের চিন্তা মন হতে দূর করে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহ পাকের হাতে উৎসর্গ করতে হয়। এরূপ করতে পারলেই কেবল আল্লাহ ভিন্ন অন্যান্য সমস্ত বস্তু হতে অন্তরে ও বাইরে রোজা রাখা হয়। আল্লাহ তায়ালার বাণী, নির্দেশ ও এর আনুষঙ্গিক কথা ছাড়া অন্য কোথাও মন দিলে রোজা এই উন্নত শ্রেণীর মধ্যে গণ্য হয় না। ইমাম গাজ্জালী (রহ) আরও বলেন, দায়ে ঠেকে সাংসারিক আবশ্যকীয় বিষয়ের প্রতি মনোযোগ প্রদান করা যদিও অসঙ্গত নয়; তবুও তাতে রোজার এই উন্নততর মর্যাদা বিনষ্ট হয়। সাংসারিক কার্যকলাপের কতগুলো কাজ পারলৌকিক কার্যের সাহায্য করে বলে সেগুলোকে সাংসারিক কার্য না বলে পরকালমুখী কার্যের মর্যাদা প্রদান করা যায়। তা সত্ত্বেও তত্ত্ববিদ আলিমগণ বলেন, সন্ধ্যাকালে কোন বস্তু দিয়ে ইফতার করা হবে দিবাভাগে তার আয়োজন করলে সেই রোজার অন্তর্নিহিত মর্যাদা হারায় এবং পাপ বলে গণ্য হবে। কেন না দিবাভাগে ইফতারের আয়োজন করলে মহাপ্রভু আল্লাহকে সকলের জীবিকা প্রদানকারী বলে দৃঢ় বিশ্বাসের মধ্যে দুর্বলতা প্রবেশ করে। নবী- রাসূল ও সিদ্দিকগণের রোজা এই উন্নত স্তরের অন্তর্ভুক্ত। তারাই আল্লাহ তায়ালার দরবারে সুউচ্চ মর্যাদা লাভ করেছেন। সকল লোক সেই উচ্চ মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয় না। আর মধ্যম শ্রেণীর রোজা হলো সাধারণ মানুষের ঊর্ধ্বে এবং আউলিয়া-বুজুুর্গদের রোজার মানের নিম্নে। শুধু পানাহার, ইন্দ্রীয় সম্ভোগ হতে বিরত হলেই রোজা এই মধ্যম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয় না; বরং সমূদয় অঙ্গ-প্রতঙ্গকে পাপ কাজ, এমনকি পাপ চিন্তা হতেও রক্ষা করতে হবে। সিয়াম সাধনার প্রকৃত মর্ম অনুধাবন করে আল্লাহ আমাদের ক্রমাগত মু’মিন মুত্তাকি ও মুহসীনের পর্যায়ভুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন।