মহামারী থেকে উত্তরণে স্বস্তিতে দেশের মানুষ, স্বাভাবিক ছন্দে জীবন

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মহামারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বছরের মাঝামাঝিতে মারা যান অনেক মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব মতে, বছরের আগস্ট মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখে দেশ। তবে সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই কমতে থাকে সংক্রমণ। এরই ধারাবাহিকতায় নিয়ন্ত্রিত সংক্রমণে করোনাভাইরাস বিষয়ে স্বস্তিতেই শেষ হচ্ছে বছর। এর অন্যতম কারণ টিকাদান কর্মসূচীর ব্যাপকতা। আর কয়েক মাসের ব্যবধানে এই কর্মসূচীতে মাইলফলক ছুঁয়েছে দেশ। ইতোমধ্যে টিকার দুই ডোজের আওতায় এসেছেন ৭ কোটির বেশি মানুষ। এক ডোজ পেয়েছেন প্রায় ১২ কোটি। টিকার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, বস্তিবাসীসহ দুর্গম চরের বাসিন্দাদেরও। তাই আবারও স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে স্কুল-কলেজসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শপিং কমপ্লেক্স, প্রার্থনালয়সহ সবকিছু। সর্বশেষ খুলে দেয়া হয়েছে দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোও। ফলে লকডাউন-কঠোর লকডাউন বা শাটডাউনের মতো শব্দগুলো এখন সুদূর অতীত বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। তবে আগামী বছরও ওমিক্রন-ডেলমিক্রনের প্রভাব বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর তাই সবক্ষেত্রে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ দিয়েছেন তারা। টিকাপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা কেটে গিয়ে এখন বাড়তি মজুদের কারণে ইতোমধ্যে বুস্টার ডোজের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ।
করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যু ও শনাক্ত দেখল দেশ : স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছরের আগস্টের ১০ তারিখ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একদিনে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়। তবে এর আগে ৫ আগস্টও সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যুর খবর জানায় অধিদফতর। জুলাই মাসেও সর্বোচ্চ মৃত্যুর কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। ওই মাসের ২৬ তারিখ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ২৪৭ জনের। এদিন সর্বোচ্চ শনাক্তের কথাও জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। ওইদিন প্রথমবারের মতো দেশে শনাক্ত হয় ১৫ হাজারের বেশি করোনা রোগী। ফলে রোগী সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকদের। এর আগে সংক্রমণ এত ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, জনসমাগম সীমিতকরণে এর আগের বছরের মতো লকডাউনও অকার্যকর বলে মনে হয় সংশ্লিষ্টদের। আর তাই জারি করা হয় কঠোর বিধিনিষেধ। বছরের ২৮ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয় এক সপ্তাহের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ। এ সময় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছিলেন, মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কাজ করবে পুলিশ, বিজিবি এবং মোতায়েন থাকবে সেনাবাহিনীও। এর আগে ২৪ জুন করোনা সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটি সারাদেশে ১৪ দিনের ‘শাটডাউন’-এর সুপারিশ করে।
অক্সিজেন সঙ্কট ॥ ২০২০ সালে দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার সময় এর মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল রাজধানী ঢাকা। মূলত চীনসহ আক্রান্ত দেশগুলো থেকে দেশে আসা যাত্রীদের মাধ্যমেই এটি দেশে ছড়িয়ে যায়। তবে তা রাজধানীকেন্দ্রিকই ছিল। কিন্তু ২০২১ সালের শুরুর দিকেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে দেখা দেয় করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। যা দেশের বিভিন্ন সীমান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশেও প্রবেশ করে। ফলে চলতি বছরে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগই ছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলগুলোতেও বাড়ে করোনার রোগী। কোথাও কোথাও রোগীদের জায়গা দিতে না পেরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেঝেতে রেখেও রোগীদের চিকিৎসা দেয়। তৈরি হয় চিকিৎসক সঙ্কট। এ সময় সবচেয়ে বেশি সঙ্কট তৈরি হয় অক্সিজেনের।
অক্সিজেন সঙ্কট নিয়ে সতর্কতাও জারি করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ভারতের টিকা রফতানি বন্ধের ঘোষণায় নিবন্ধন কার্যক্রম স্থগিত : চলতি বছরেই শুরু হয় দেশে প্রথম করোনার টিকা দেয়া। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকা দিয়ে ২৭ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় করোনার টিকাদান কার্যক্রম। ওই সময় করোনার টিকা নিয়ে নানা সমালোচনা, গুজবের কারণে অনেকেই অনীহা প্রকাশ করেন টিকা নিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ টিকা সম্পর্কিত এক জরিপের প্রেক্ষিতে তখন জানায়, বাংলাদেশের মাত্র ৩২ শতাংশ মানুষ টিকা কার্যক্রমের একেবারে শুরুতে টিকা নিতে আগ্রহী। আরও ৫২ শতাংশ আগ্রহী, তবে তারা এখনই নয়, বরং দেখে শুনে পরে নিতে চান। প্রায় ২৬০ জন প্রত্যাখ্যান করার পর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা রাজি হন প্রথম করোনা টিকা গ্রহণ করতে। এদিন টিকা দেয়া হয় আরও ২৬ জনকে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন এ কার্যক্রমের। এ সময় রুনু ভেরোনিকা কস্তা বলেছিলেন, তিনি চান তাকে দেখে বাংলাদেশের মানুষ যেন টিকা নিতে অনুপ্রাণিত হন এবং তাদের মনের ভেতর যেন টিকা নিয়ে কোন ভয়ভীতি না থাকে।
টিকা পেতে নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা এবং সাফল্য : ভারতের রফতানি বন্ধের ঘোষণার পরপরই টিকা পেতে নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে সরকারের বিভিন্ন দফতর। এরই সুফল হিসেবে বিভিন্ন সময় চীনের সিনোফার্ম, যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না ও ফাইজারের টিকাও পায় বাংলাদেশ। অনিশ্চয়তা কাটিয়ে নতুন উদ্যোমে টিকাদান কর্মসূচী শুরু হয় আবারও। ১ জুলাই দেশজুড়ে আবারও শুরু হয় করোনাভাইরাসের টিকা কার্যক্রম। তবে এবার চীনের ওষুধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মের সিনোভ্যাক দিয়ে নতুন করে শুরু হয় টিকাদান কর্মসূচী। এছাড়াও দেয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজারের টিকা ফাইজার বায়োএনটেক। কিছু দিন পর দেয়া হয় মডার্নার টিকাও। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, সিনোফার্ম কেনার জন্য চীন থেকে সাড়ে ৭ কোটি টিকার অর্ডার দেয়া হয়েছে। প্রথমে অর্ডার দেয়া হয় দেড় কোটি টিকার। পরে আরও ৬ কোটি টিকার অর্ডার দেয়া হয়। প্রতি মাসে ২ কোটি করে আগামী তিন মাসে এই ছয় কোটি টিকা পাওয়া যাবে বলে তিনি জানান। খুলল স্কুল-কলেজ : মহামারী করোনার কারণে প্রায় ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর ১২ সেপ্টেম্বর খুলে দেয়া হয় দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। খুলে দেয়া হয় স্কুল-কলেজ। এর মধ্য দিয়ে আবারও প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সশরীরে শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত হয়ে ক্লাস করে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফিরে আসে উন্মাদনা। দেশের প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুখরিত হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের পদচারণা। এর আগে দেশে করোনার সংক্রমণের শুরুর দিকে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ দেয়। এরপর গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত একাধিকবার শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে ফেরাতে উদ্যোগ নেয়া হলেও করোনার সংক্রমণ দফায় দফায় বাড়ায় তা আর বাস্তবায়িত হয়নি।
স্বাভাবিক হলো দোকানপাট, শপিংমল, গণপরিবহন, পর্যটন কেন্দ্রগুলো : করোনা তখনও না কমলেও মানুষের জীবিকা নির্বাহের তাগিদে ৮ এপ্রিল দোকানপাট, শপিংমল খোলার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ওই দিন এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, ৯ এপ্রিল থেকে দোকানপাট ও শপিংমল সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে।
করোনার টিকার বুস্টার ডোজ দেয়া শুরু : টিকার মজুদের সাপেক্ষে চলতি মাসের ১৯ তারিখ দেশে উদ্বোধন করা হয় করোনার টিকার বুস্টার ডোজের। প্রথমবারের মতো এবারও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্সের রুনু ভেরোনিকাই নেন বুস্টার ডোজের প্রথম ডোজ।
স্বস্তিতে বছর সমাপ্তি : ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণ দেখা দেয়ার তিন মাস পর ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর ভাইরাসটির বহুমুখী রূপ দেখে দেশের মানুষ। উর্ধমুখী সংক্রমণ থেকে নিম্নমুখী আবার নিম্নমুখী পর্যায় থেকে উর্ধমুখী। তবে বছরের শেষ কয়েক মাস বেশ স্বস্তিতেই রয়েছে শনাক্ত এবং সংক্রমণ পরিস্থিতি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া সর্বশেষ তথ্যনুযায়ী ২৭ ডিসেম্বর দেশে করোনায় শনাক্ত হন ৩৭৩ জন। এ সময় মারা যান ১ জন। গত প্রায় এক মাস যাবত মৃত্যু এবং শনাক্তের একই রকম থাকায় তাই স্বস্তিতেই ২০২১ সাল শেষ হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তবে দেশের করোনার বিস্তার যেহেতু মার্চ-এপ্রিলেই হয় সেহেতু নতুন বছরে কিছুটা আশঙ্কা নিয়েই শুরু হবে।