পারিবারিক আদালত অবমাননা, কঠিন শাস্তি দিতে হবে ॥ হাইকোর্ট বেঞ্চের পূর্ণাঙ্গ রায়

14

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বর্তমানে পারিবারিক আদালত অবমাননার শাস্তির বিধান খুবই নগন্য। অবমাননাকারীর শাস্তি মাত্র দুই শ’ টাকা। এই শাস্তির বিধান সংশোধন করে আরও কঠিন করা বাঞ্ছনীয়। আদালত প্রত্যাশা করে সরকারের নীতি নির্ধারক মহল এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেবিবেচনা করে অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। পাশাপাশি শিশুদের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত সম্পর্কে মামলাগুলো এত দীর্ঘ সময় ধরে চলমান থাকা দুঃখ ও হতাশাজনক এবং ন্যায়নীতির পরিপন্থী। মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। সন্তানদের হেফাজত নিয়ে মায়ের দায়ের করা রিট খারিজ করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ কথা বলেছেন। শনিবার সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে এ রায় প্রকাশ করা হয়েছে।
আদালত তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, পারিবারিক আদালতসমূহের বিভিন্ন আদেশ বিশেষত : শিশু সন্তানকে দেখা সাক্ষাতের আদেশ সংশ্লিষ্ট পক্ষ মান্য করছে না। ফলশ্রুতিতে তারা হাইকোর্ট বিভাগে এসে হেবিয়াস করপাস অধিক্ষেত্রে আশ্রয় গ্রহণ করছেন। পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৮৫ এর ধারা ১৯ অনুযায়ী পারিবারিক আদালতকে অবমাননা করা হলে অবমাননাকারীকে মাত্র দুই শ’ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। সময়ের বাস্তবতায় পারিবারিক আদালত অবমাননার শাস্তির এই বিধানটি সংশোধন করে আরও কঠোর করা বাঞ্ছনীয়। রায়ে আদালত মামলার সামগ্রিক প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ওই মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত শিশু সন্তানটি বাবার হেফাজতে রাখার সিদ্ধান্ত দেন। তবে মা রাজশাহীর বাসায় কিংবা রাজশাহী শহরের যেকোন স্থানে শিশু সন্তানের সঙ্গে দেখা ও একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন। কিন্তু রাজশাহী শহরের বাইরে নিতে পারবেন না।
আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৯ অনুযায়ী দেশের সকল পারিবারিক আদালতসমূহে শিশু সন্তানদের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত সম্পর্কিত মামলাসমূহ যাতে ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেছে আদালত। আইন সচিব ও সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ৭ নবেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ শুনানি শেষে রায় প্রদান করেন। আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট মোঃ মোতাহার হোসেন সাজু। অপরপক্ষে ছিলেন ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডিএজি বিপুল বাগমার। প্রকাশের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার প্রবলেন, এটা একটি যুগান্তকারী রায়। এই রায় বাস্তবায়ন হলে পারিবারিক আদালত ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব হবে।
মামলা সূত্রে জানা যায়, রংপুরের মেয়ের সঙ্গে ২০১১ সালে বিয়ে হয় রাজশাহীর এক ছেলের। ২০১৫ সালে তাদের কন্যাশিশুর জন্ম হয়। ২০১৮ সালে ওই দম্পতির বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। এরপর শিশুটি তার বাবার কাছে ছিল। এ অবস্থায় শিশুটিকে ফিরে পেতে হাইকোর্টে রিট করেন শিশুটির মা। এর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। রায়ে বলা হয়েছে, হেবিয়াস করপাস রিট মোকদ্দমায় শিশু অভিভাবকত্ব নির্ধারণে সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট পারিবারিক আদালতেই তা নির্ধারিত হবে। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট পারিবারিক আদালতকে আগামী বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে উক্ত মামলাটি নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়া হলো। সংশ্লিষ্ট পক্ষগণকে এ বিষয়ে আদালতকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানে নির্দেশ দেয়া হলো। বর্তমান মামলার সার্বিক প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি বিশেষত শিশু সন্তানের সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনা নিয়ে উক্ত মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত শিশু সন্তানটি বাবার হেফাজতে থাকার সিদ্ধান্ত দেয়া হলো। এবং রিট আবেদনকারী রেসপন্ডেন্ট-২ এর রাজশাহীর বাসায় কিংবা রাজশাহী শহরের যে কোন স্থানে শিশু সন্তানের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত ও একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন। তবে রাজশাহী শহরের বাহিরে নিতে পারবেন না। এ বিষয়ে রেসপন্ডেন্ট-২ (বাবা) কে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেয়া হলো। রাজশাহীর জেলা সমাজকল্যাণ অফিসার ও মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে যে কোন পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করা হলো।
রায়ে আরও বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে হাইকোর্ট বিভাগে অত্র বেঞ্চে পিতা-মাতার বিয়ে বিচ্ছেদ, মনোমালিন্য, দাম্পত্য কলহসহ বিভিন্ন কারণে শিশুদের হেফাজত সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হেবিয়াস কারপাস মামলা পরিচালনা করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। আদালত এত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে যে, পারিবারিক আদালতসমূহে শিশুদের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত সম্পর্কে মামলাসমূহ দীর্ঘ সময় ধরে চলমান। আদালতের নজরে এসেছে যে, ২০১০ সাল, ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের দাখিলকৃত মামলাসমূহ এখনও বিচারাধীন। শিশুদের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত সম্পর্কে মামলাগুলো এত দীর্ঘ সময় ধরে চলমান থাকা দুঃখ ও হতাশাজনক এবং ন্যায়নীতির পরিপন্থী। এ সময় মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।
রিট আবেদনকারীর বক্তব্য এই যে, ২০১১ সালের ২৫ ডিসেম্বর রংপুরের মেয়ে ও রাজশাহীর এক ছেলের ২০১১ সালে বিয়ে হয়। ২০১৫ সালে তাদের কন্যাশিশুর জন্ম হয়। ২০১৮ সালে ওই দম্পতির বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। এরপর শিশুটি তার বাবার কাছে ছিল। এ অবস্থায় শিশুটিকে ফিরে পেতে হাইকোর্টে রিট করেন শিশুটির মা। এর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। এর আগে শিশুটির মা পারিবারিক আদালতে একটি মামলা করেন। রুলের শুনানি শেষে আদালত উপরোক্ত রায় দেন। রেসপন্ডেন্ট-২ বর্তমান রুলটিতে একটি জবাবি হলফনামা দাখিল করেছেন। উক্ত হলফনামায় উল্লেখ করা হয় যে, শিশু সন্তানের দেখাশোনার বিষয়ে আবেদনকারী সর্বদাই উদাসীন ছিলেন। এবং শিশু সন্তানটির দেখাশোনার দায়িত্ব মূলত গৃহপরিচালিকারা পালন করতেন। শিশু সন্তানটির বয়স যখন ৬ মাস অর্থাৎ ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর অজ্ঞাত ব্যক্তির সঙ্গে রিট আবেদনকারীর তাদের ছেড়ে চলে যান। যদিও ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর তালাকের নোটিস প্রেরণ করেন। আবেদনকারী শিশু সন্তান রেখে চলে গেলে রেসপন্ডেন্ট-২ গৃহপরিচারিকা সহায়তায় তার সেবা ও পরিচর্যা করে আসতে থাকেন। ২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা হতে রাজশাহী বদলি করলে তিনি রাজশাহীতে যোগদান করেন। তখন হতে শিশু সন্তানসহ তিনি রাজশাহীতে কর্মস্থলে পিতামাতার সঙ্গে অবস্থান করছেন। আবেদনকারীর কর্তৃক তালাক প্রদানের দুই বছর পর ২০২০ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি পুনরায বিয়ে করেছেন। বিয়ের সময় নববিবাহিত স্ত্রী চাকরিরত থাকলেও শিশু সন্তানটির লালন-পালনের প্রয়োজনে উক্ত চাকরি হতে ইস্তফা প্রদান করেছেন। শিশু সন্তানটিকে রাজশাহী নিয়ে আসার বিষয় আবেদনকারীর পিতা অবগত আছেন এবং তার পিতা-মাতার সম্পত্তিতেই শিশুটিকে রাজশাহী নিয়ে আসা হয়। আবেদনকারী রাজশাহীতে এসে রেসপন্ডেন্ট-২ (বাবা) তার বাসায় দেখা সাক্ষাতের সুযোগ করে দেন। তবে শিশু সন্তানটিকে বাহিরে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি শিশুর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তাতে সম্মত হননি। শিশু সন্তানটি মায়ের হেফাজতে যেতে আগ্রহী নন। ইতোমধ্যে শিশু সন্তানটিকে প্রথমে রাজশাহী শিমুল মেমোরিয়াল নর্থ সাউথ স্কুলে ভর্তি করা হয়। বর্তামনে সে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজে অধ্যায়নরত।
এ্যাডভোকেট মোতাহার হোসেন সাজু রায় ঘোষণার দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমার মক্কেলকে (শিশুর মা) তার স্বামী অনেক নির্যাতন করতেন। পরে তাকে তালাকও দেন। এ ঘটনায় শিশুকে জিম্মায় চেয়ে মা হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। ওই রিটের শুনানি শেষে আদালত দেখেন ২০১৮ সালের মামলায় এখনও অগ্রগতি নেই। তাহলে তো সন্তান হেফাজতে চেয়ে করা মামলা তিন বছর ধরে নিম্ন্ন আদালতে পড়ে থাকে। এটি দেখে আদালত ছয় মাসের মধ্যে এ ধরনের মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে আমাদের যে মামলাটি আছে সেটি মার্চ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বলেছেন।