কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাঙালির নবান্ন উৎসব আজ। আজ ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ ফসলকেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন উৎসবে মাতার আনন্দঘন দিন। নতুন ধানে হয় নবান্ন। অনাদিকাল ধরে গ্রামীণ জনপদে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। রাজধানী শহরে একই উৎসব পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা। আজ ভোরে ওস্তাদ গাজী আবদুল হাকিমের বাঁশির সুরে শিল্পকলা একাডেমিতে উৎসবের সূচনা করা হবে। আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য মেনে ঢাকায়ও আজ থাকবে বর্ণাঢ্য আয়োজন। ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বিকেলে নাগরিক নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হবে। লোকায়ত জীবন ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জয়গান করা হবে উৎসব মঞ্চ থেকে। শহুরে প্রলোভন কর্পোরেট সংস্কৃতি আর নিজেকে ভুলে থাকার এই সময়ে আলাদা তাৎপর্যের হয়ে উঠেছে নবান্ন উৎসব। গ্রামের নরম মাটিতে নাড়ি পুঁতে আসা বাঙালি স্মৃতিতে হলেও গ্রামে ফিরে যাবে। শহর, গ্রাম সর্বত্রই লাগবে হাসিরাশি আনন্দের ঢেউ।
অবশ্য আরও আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ফসলের ঋতু হেমন্ত। কার্তিকের প্রথম দিন নতুন ঋতুকে স্বাগত জানানো হয়। এক সময় মরা কার্তিকে এসে কৃষকের গোলা শূন্য হয়ে যেত। অভাব দেখা দিত খাবারের। সবাই তখন তাকিয়ে থাকত অগ্রহায়ণের দিকে। তবে যতদিন গেছে ততই বদলে গেছে হিসেব-নিকেষ। কার্তিক আর আগের মতো নেই। এ মাসেও পাওয়া যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ ধান। বস্তুত শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে এখন মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। আয় রোজগারও ভাল। কার্তিক মাসে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আগাম আমন ধান কাটার উৎসব। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে পুরোদমে। বরগুনা, রংপুর, নীলফামারীসহ কয়েকটি জেলার কৃষক ব্যস্ত সময় পার করছেন এখন। কৃষকরা বাড়তি লোক নিয়ে ফসলের মাঠে যাচ্ছেন। দিনভর চলছে ধান কাটা। তারপর ফসল কাঁধে বাড়ি ফিরছেন। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমাণ কিষানি। ধান মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনেই অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে তাদের। তবে মূল অপেক্ষা ছিল অগ্রহায়ণের। অগ্রহায়ণ মানেই আমন ধান কাটার মাস। ফলন ও উৎপাদনে বোরোর চেয়ে আমন পিছিয়ে থাকলেও প্রতি বছর এর উৎপাদন বাড়ছে। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, ২০২০ সালে আমনের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ টন, যা মোট উৎপাদনের ৩০ শতাংশ। এবারও বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। আজকের নবান্ন উৎসব তাই যথারীতি আনন্দঘন হবে।
নবান্ন মানে নতুন অন্ন। নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। হাজার-হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা যখন চালু হয়েছিল, অনুমান করা হয়, তখন থেকেই নবান্ন উৎসব উদ্যাপন হয়ে আসছে। ঘরে ফসল তোলার আনন্দে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো। ফসল কাটার আগে কৃষকরা বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখতেন। বাকি ধান থেকে চাল করে সে চালে পায়েস করা হতো। এ ছাড়াও নবান্ন উৎসবের দিন গৃহস্থ বাড়িতে নানা পদ রান্না হতো। শাক, ভর্তা, ভাজিসহ কুড়ি থেকে চল্লিশ পদের তরকারি রান্না করা হতো কোন কোন বাড়িতে।
যতদূর তথ্য, হাজার-হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা চালু হবার পর থেকেই নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে। তখন থেকেই ঘরে ফসল তোলার আনন্দে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। লোক কবির ভাষায়- ‘আইলো অঘ্রাণ খুশীতে নাচে প্রাণ/ চাষি কাচিতে দিলো শান/ কাচি হাতে কচ কচা কচ কাটে চাষি পাকা ধান…।’ নতুন এই ধান ঘরে তোলার পর আয়োজন করা হয় নবান্ন উৎসবের।
সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, নবান্ন উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় কিছু আনুষ্ঠানিকতাও যোগ হয়। হিন্দুরা নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করেন। পার্বণ বিধি অনুযায়ী হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। শাস্ত্র মতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়। কে চায় অমন পাপ করতে!
অমুসলিম রীতিতে, নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে। আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন। নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলী’। অতীতে পৌষসংক্রান্তির দিনও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল। কাকবলীর আগে আরও তিনটি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার নিয়ম রয়েছে। সেগুলো হচ্ছেÑ লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ ও বীরবাশ। বীরবাশের প্রথা মূলত বরিশাল অঞ্চলের। এর নিয়মানুযায়ী, বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটি গর্ত করা হয়। তার চারপাশে পিটুলী দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। এর পর গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোঁতা হয়। সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে বাঁধা হয় ধানের ছড়া। নবান্ন উৎসবে কাকবলী, লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ হয়ে গেলে সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন। এর আগে কেউ কিছু মুখে নেন না।
অবশ্য এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে। সনাতন মাড়াই প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। যন্ত্রযুগে প্রবেশ করেছে গ্রাম। কৃষি ছাড়াও আয়ের অনেক উৎস সৃষ্টি হয়েছে। চাকরির সুযোগ বেড়েছে। সম্প্রসারিত হয়েছে ব্যবসা। অল্পে বেশি মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। শুধু তাই ধানের জমির দিকে আর তাকিয়ে থাকতে হয় না। আর নাগরিক জীবনে নতুন ধান বা চালের তেমন কোন অস্তিত্বই নেই। নেই বললেই চলে।
তদুপরি এবার সময়টা বৈরী। মাঠে ফসল ভাল হলেও, করোনার বাধায় সবকিছু কেমন থমকে আছে। সারাদেশেই কমবেশি ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রমণ ব্যাধি। এ অবস্থায় নবান্ন উৎসবের কী হবে? এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, ফসল ভাল হওয়ায় মনের শক্তি ধরে রেখেছেন তারা। ধান কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নতুন ধান ঘরে তোলা উপলক্ষে এবারও ঘরে ঘরে নানা পদ রান্না করা হবে। থাকবে পিঠাপুলি পায়েসের আয়োজন। নেমন্তও বাদ যাবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রাজধানী শহর ঢাকায় ২০ বছরের বেশি সময় ধরে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। বেশ ঘটা করে বর্ণিল এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। শহুরে শেকড় সন্ধানী সংস্কৃতি কর্মীরা লোক আঙ্গিকের গান নাচ ইত্যাদি পরিবেশনের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেন। চলে খৈ মুড়ি পীঠা পুলির আয়োজনও। সাধারণত চারুকলার বকুলতলায় নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। কিন্তু করোনাকালে সেই যে বন্ধ হয়েছিল চারুকলার গেট, আজও খুলেনি। শিক্ষা কার্যক্রম চললেও, জাতীয় উৎসব আয়োজনের আকর্ষণীয় স্থানটি আয়োজকদের জন্য খুলে দেয়া হয়নি।
তাই নবান্ন উৎসব আয়োজন করা হবে শিল্পকলা একাডেমির খোলা প্রাঙ্গণে। আয়োজকরা জানান, সকাল সাড়ে ৭টায় শুরু হবে উৎসব। এতে নাচ গান কবিতা ও কথায় নবান্ন উৎসবের ঐতিহ্য ও আনন্দ তুলে ধরা হবে। সে লক্ষ্যে শিল্পকলা একাডেমির খোলা চত্বরে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। লোক চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে এ মঞ্চ সাজানো হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে গ্রামীণ নানা অনুষঙ্গ। সঙ্গীত নৃত্য ও কবিতার ভাষায় ফসলকেন্দ্রিক অর্থনীতি ফুটিয়ে তোলা হবে। জয়গান করা হবে কৃষকের। নাগরিক জীবনে ভুলতে বসা লোকসংস্কৃতি নতুন করে প্রাণ পাবে নবান্ন উৎসবের মঞ্চে। নানা পরিবেশনা ছাড়াও উৎসবে আগতদের পীঠাপুলি দ্বারা আপ্যায়ন করা হবে।
আয়োজন সম্পর্কে নবান্ন উৎসব উদ্যাপন পরিষদের সহসভাপতি মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, আজকের প্রজন্ম আমাদের মৌলিক সংস্কৃতি ও ফসলকেন্দ্রিক উৎসবগুলো সম্পর্কে জানে না। জানানোর দায় থেকে এবারও নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। সবাইকে এ উৎসবে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানান তিনি।