কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করলেও মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না। গ্রেফতার-জরিমানা উপেক্ষা করে তুচ্ছ অজুহাতে ঘর থেকে বের হয়ে আসছেন তারা। কঠোর বিধিনিষেধের পঞ্চম দিনে রাজধানীতে ছিল বিপুলসংখ্যক যানবাহন ও মানুষের চলাচল। পাড়া-মহল্লায় দোকানপাটও খুলেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেখা গেছে তরুণদের আড্ডা। কিছু কিছু এলাকায় যানজটও চোখে পড়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ক্রমশ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে করোনা। সোমবার মৃত্যু এবং আক্রান্তের নতুন রেকর্ড হয়েছে। প্রতিদিনই ভাঙছে আগের দিনের রেকর্ড। গত কয়েকদিনের আক্রান্তের পরিসংখ্যান দেশে মারাত্মক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছে সরকার। প্রথম দুই-তিনদিন লকডাউন পরিস্থিতি ঠিক থাকলেও ক্রমশ তা ঢিলেঢালা হয়ে যাচ্ছে। বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে মানুষ তুচ্ছ অজুহাতে ঘর থেকে বের হচ্ছে। রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতেও কাজ হচ্ছে না। গত পাঁচ দিনে রাজধানীতে প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু সোমবার মেট্রোপলিটন পুলিশ গ্রেফতার করেছে ৪১৩ জন, জরিমানা করেছে ২৪৩ জনকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে কঠোর বিধিনিষেধে শিথিল থাকা শর্তগুলোকে কাজে লাগানো হচ্ছে। অজুহাতের মধ্যে থাকছে, ডাক্তার দেখানো, হাসপাতালে রোগী দেখতে যাওয়া, ওষুধ কিনা, খাবার কিনতে দোকানে বা বাজারে যাওয়া, ব্যাংকে টাকা জমা ও তুলতে যাওয়া ইত্যাদি। মানুষের মাঝে ভয়ভীতি নেই। টানা চারদিন বন্ধ থাকার পর সোমবার সংক্রমণের উর্ধগতি মাথায় নিয়েই খুলেছে ব্যাংক-বীমা, শেয়ারবাজার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ফলে সকাল থেকেই মানুষের চলাচল বেড়েছে রাজধানীর সড়কে।
গত চারদিনের তুলনায় সোমবার বিভিন্ন সড়কে অধিকসংখ্যক প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, জিপগাড়ি, ছোট-বড় লরি, ট্রাক, মোটরসাইকেল ও রিক্সা চলাচল করতে দেখা গেছে। পথচলা মানুষের উপস্থিতিও বেড়েছে। কর্তব্যরত বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- এদিন ব্যাংক খোলা থাকায় প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষজন ঘর থেকে বের হয়েছে। এজন্য সড়কে যানবাহন ও মানুষের ব্যস্ততা চোখে পড়ে। মানুষ ও যানবাহনের পাশাপাশি রিক্সার উপস্থিতি বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়- সরকারী-বেসরকারী অফিস বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও বেশ কিছু অফিস খোলা রয়েছে। মূলত সেসব অফিসগামীর কারণেই সড়কে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আগের চারদিনের তুলনায় সড়কে মানুষ, রিক্সা, যানবহন অনেক বেড়েছে। শুধু চলছে না গণপরিবহন। এছাড়া সব কিছুই চলছে। তুচ্ছ অজুহাতে বের হতে গিয়ে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতে অনেককেই গুনতে হয়েছে জরিমানা। বিড়ালের খাবার বিক্রি কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় কাঁচাবাজার করার অজুহাত দেখানোর মতো ঘটনায় র্যাব জরিমানা করেছে। পঞ্চম দিনে কঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে বিভিন্ন চেকপোস্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও সক্রিয় দেখা গেছে। তাদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, মানুষকে জরিমানা করা কিংবা শাস্তি দেয়া তাদের উদ্দেশ্য নয়। সচেতন করে ঘরে রাখাই তাদের উদ্দেশ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই উদ্দেশ্য খুব একটা সফল হচ্ছে বলে মনে হয় না। বিশেষজ্ঞদের অভিমত-প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল আরও জোরদার ও কঠোর করা দরকার। এত নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে না।
কঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে মাঠে রয়েছেন পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা। বিধিনিষেধের শুরু থেকেই বিভিন্ন জায়গায় টহল দিতে দেখা গেছে তাদের। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে চেকপোস্টে চালানো হচ্ছে তল্লাশি। সোমবার রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর উত্তরা বিমানবন্দর, বনানী মহাখালী তেজগাঁও, ফার্মগেট, শুক্রাবাদ, কলাবাগান, ধানমণ্ডি ২৭, ৩২ নম্বর ও পান্থপথ সড়ক ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকায় মানুষের চাপ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বিভিন্ন যানবাহনের চাপ। ব্যক্তিগত গাড়ি বেশি বের হওয়ায় চেকপোস্টে জট লেগে আছে। গত চারদিনে রাজধানীর কোন সিগন্যালেই অপেক্ষা করতে না হলেও পঞ্চমদিনে প্রতিটি সিগন্যালেই ৪-৫ মিনিট করে যানবাহনগুলোকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কোন কোন সিগন্যালে প্রায় ৭/৮ মিনিটের মতো অপেক্ষা করতে হয়েছে। সকাল থেকেই এসব সড়কে ছিল অফিসমুখী মানুষের চাপ। প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, স্টাফ বাসসহ অন্যান্য গাড়ির চাপে প্রায় প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যালেই তৈরি হয় যানজটের। সড়কে মানুষের চলাচল বাড়লেও লকডাউন বাস্তায়নে চেকপোস্টগুলোতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের সমন্বিত এসব চেকপোস্টে পুলিশের পাশাপাশি সেনা সদস্যদেরও দেখা যায়। ধানমণ্ডি-৩২ নম্বর এলাকার রাসেল স্কয়ার মোড়ের চেকপোস্টে যৌথ তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ ও সেনাবাহিনী। চেকপোস্ট পার হতে ব্যাংক কর্মকর্তা অথবা সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের নিজের পরিচয় দিতে হচ্ছিল। দেখাতে হচ্ছিল নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের বৈধ পরিচয়পত্র। এ সময় অনেককেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। মিরপুর-১ নম্বর সিগন্যালে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট কামাল বলেন, সকাল থেকে রাস্তায় মানুষের যে চাপ তা দেখে মনেই হবে না দেশে কঠোর লকডাউন চলছে। যারা বের হয়েছেন তারা হয়তো জরুরী প্রয়োজনেই বের হয়েছেন।
বিমানবন্দরে কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলেছেন, আগের চারদিনের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে যানচলাচল ও মানুষের আনাগোনা। ব্যাংক-বীমা ও শেয়ারবাজার খোলার অজুহাতে অনেকেই অকারণে এবং ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ে নানান অজুহাত দিচ্ছেন। এসব নিয়ন্ত্রণে চেকপোস্টগুলোতে তৎপরতা বাড়ানো হয়। দুপুরে কলাবাগান এলাকার চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশের উপপরিদর্শক সুমিত আহমেদ জানান, সড়কে যারা বের হয়ে জরুরী পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক বৈধ পরিচয়পত্র দেখানোর পরই যেতে দেয়া হচ্ছে। গত চারদিনের তুলনায় আজ সড়ক একটু বেশি চাপ যাচ্ছে। অকারণে সড়কে বের হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক। ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এমন অজুহাত দিয়ে অনেকেই ব্যক্তিগত কাজে বের হয়েছেন বলে জানান ট্রাফিক পুলিশের ধানমণ্ডি জোনের উপকমিশনার জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, আজ থেকে ব্যাংক খোলা হওয়ায় সডকে অন্যান্য দিনের তুলনায় গাড়ির চাপ বেড়েছে। গত চারদিন ধরে শুধু হাসপাতাল এবং অন্যান্য জরুরী পরিষেবায় যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের চলাচল ছিল। সোমবার আবার ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাড়িও যুক্ত হয়েছে। তবে এই ফাঁকে অনেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত কাজেও বের হচ্ছে।
এদিকে সোমবারও চেকপোস্টগুলোতে দেখা গেছে বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবার জন্য জবাবদিহি করতে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাসেল স্কয়ার থেকে গাবতলী ব্রিজ পর্যন্ত যেতে পুলিশের মোট পাঁচটি চেকপোস্ট চোখে পড়ে। কোন চেকপোস্টে পুলিশ সদস্যদের ছাতা মাথায় নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। আবার কোনটিতে কেউই নেই। কোথাও কোথাও আবার কিছুটা চেকিং। সকালে মিরপুর রোড ধরে রাসেল স্কয়ার থেকে গাবতলী ব্রিজ পর্যন্ত এমন চিত্রই দেখা গেছে। অন্যগুলোতে ঢিলেঢালা ভাব থাকলেও কিছুটা কঠোর অবস্থানে গাবতলী পুলিশ চেকপোস্ট। আর রাসেল স্কয়ার চেকপোস্টে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের যৌথ কার্যক্রম লক্ষ্য করা গেছে। সড়কে দায়িত্বে থাকা কয়েকটি চেকপোস্টের পুলিশ সদস্যরা বলছেন, কল্যাণপুর-গাবতলীর দিকে সকালের পর হঠাৎ গাড়ির চাপ কমে গেছে। তাই মনে হতে পারে রাস্তায় পুলিশ শিথিলতা দেখাচ্ছে। মিরপুর সড়ক ঘুরে দেখা যায়- কল্যাণপুর ফুটওভার ব্রিজের নিচের চেকপোস্টে তিন থেকে চারজন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। টেকনিক্যাল মোড়ে থাকা চেকপোস্ট আছেন দুই-তিনজন সদস্য। এই দুটি চেকপোস্টে কোন গাড়িকে দাঁড় করিয়ে চেক করতে দেখা যায়নি।