কাজিরবাজার ডেস্ক :
অর্থনীতি সচল রেখেও করোনায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। বিশ্বের করোনা আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলো এই নীতিতেই চলছে। এই নীতির অংশ হিসেবে ক্রমশ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল করার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষায়ও বিধি নিষেধ কঠোর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কঠোর বিধি নিষেধ মানার শর্তে দোকানপাট খুলে দেয়ার পর অভ্যন্তরীণ রুটে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। ঈদের পর ধীরে ধীরে আরও শিথিল করা হবে বিধি নিষেধ। প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক লকডাউন চালু রাখা হবে। তবে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে কোন প্রকার আপোস করা হবেনা। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কঠোর অবস্থান গ্রহণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া
হয়েছে। দেশে এখন চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এরপর তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের বড় বড় দেশ তৃতীয় ঢেউ মোকাবেলা করছে। প্রতিবেশী ভারতে দ্বিতীয় ঢেউয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ল-ভ- হয়ে গেছে। এর পরও কঠোর লকডাউনের পথে হাঁটেনি তারা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যতটা সম্ভব অর্থনৈতিক কর্মকা- স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। বিষয়গুলো মাথায় রেখে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হচ্ছে সরকারের নীতি নির্ধারক মহলকে। সরকারের একাধিক নীতি নির্ধারকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, লকডাউনের মধ্যে দোকানপাট খুলে দেয়ার আগে এ নিয়ে একাধিক ফোরামে আলোচনা হয়। দেশের অর্থনীতিবিদদের মতে, লকডাউন কঠোরভাবে পালন করলে হয়তো করোনা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি সম্ভব। একই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কথাও বিবেচনা করতে হবে। করোনা থেকে রক্ষা করতে গিয়ে মানুষকে ক্ষুধা ও দারিদ্রের দিকে ঠেলে দেয়া হবে জাতির জন্য আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো করোনার প্রথম ঢেউয়ে লকডাউন কঠোর করেছিল। তখন কোন মানুষকে বিনা প্রয়োজনে রাস্তায় থাকতে দেয়া হতো না। কোন কোন রাষ্ট্রে কঠোর ব্যবস্থায় শারীরিক নির্যাতন, জেল-জরিমানাও করা হয়। ফলে অনেক উন্নত দেশও মারাত্মক অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউয়ে এই সব দেশই অর্থনীতি সচল রেখে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নীতি গ্রহণ করেছে।
দেশে করোনার প্রথম ঢেউ সফলভাবে মোকাবেলার পর জনজীবন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া খোলা হয়েছিল সবকিছু। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ারও চিন্তা ভাবনা শুরু হয়। এর মধ্যে মার্চ মাসে শুরু হয় দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে দ্বিতীয় ঢেউ হয়ে উঠে মারাত্মক। সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার উর্ধমুখী হয় দ্রুত। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তাই হয়েছে। পরিস্থিতি সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠলে সরকার লকডাউনের ঘোষণা দেয়। প্রথম সপ্তাহের লকডাউনে জরুরী সার্ভিস এবং কাঁচাবাজারসহ সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কয়েকদিন তা পালিতও হয়। শেষ পর্যন্ত জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে ঘর থেকে বের হতে শুরু করে। দ্বিতীয় সপ্তাহে লকডাউন অনেকটাই শিথিল হয়ে যায়। ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন। বিক্ষোভ ও অবরোধ করে লকডাউন শিথিলের দাবি জানাতে থাকেন। এর পরই সরকারের নীতি নির্ধারকরা অর্থনীতি সচল রেখে করোনা নিয়ন্ত্রণের চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে পরামর্শক কমিটির একাধিক বৈঠকের পর সরকার শর্তসাপেক্ষে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে গোটা লকডাউনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্প কারখানা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়।
লকডাউনে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। আক্রান্তের হার ২৪ শতাংশ থেকে নেমে ১০ এর কাছাকাছি হয়। কমতে শুরু করে মৃত্যুর সংখ্যাও। সরকার লকডাউন আরও শিথিল করার ঘোষণা দেয়। গণপরিবহন বন্ধ রেখে সীমিত আকারে খোলা হয় শপিংমল ও দোকানপাট। প্রথম ঘোষণায় ছিল সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা। পরে তা বাড়িয়ে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা করা হয়। সর্বশেষ জেলা ও শহরের অভ্যন্তরীণ গণপরিবহন চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। আজ বৃহস্পতিবার থেকে তা কার্যকর হবে। তবে যাত্রীদের মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। এইসব পরিবহন শহর কিংবা জেলার বাইরে যেতে পারবে না। গণপরিবহন খোলা হলেও বন্ধ রাখা হয় আন্তঃনগর বাস, ট্রেন এবং লঞ্চ সার্ভিস। ঈদের পর পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক লকডাউনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যেসব এলাকায় আক্রান্তের পরিমাণ বেশি সেইসব এলকায় লকডাউন রেখে কম আক্রান্ত এলাকায় বিধি নিষেধ শিথিল করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সামনে ঈদুল ফিতরে করোনা বিস্তারের আশঙ্কা রয়েছে। এই সময় সাধারণ মানুষ কর্মস্থল থেকে ঘরে ফিরে যায়। গ্রামমুখী হয় শহরে বসবাসকারী মানুষ। এতে করোনার বিস্তার বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ভারতে এখন শহর ছাড়িয়ে গ্রাম পর্যায়েও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে গ্রাম পর্যায়ে করোনা আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গ্রামে গ্রামে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুবরণ করছে শত শত মানুষ। দেশেও জরিপ করে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরের তুলনায় মফস্বলের শহরগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। মঙ্গলবার একটি বেসরকারী টেলিভিশনের রিপোর্টে দেখানো হয়, রাজধানীতে যেখানে মৃত্যুর হার এক দশমিক ৪, সেখানে ময়মনসিংহ কিংবা বগুড়ায় মৃত্যুর হার দুই শতাংশের উপরে। মূলত চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতাই এর কারণ। বড় শহরগুলোতে যত সহজে চিকিৎসা পাওয়া যায়, ছোট শহর কিংবা গ্রাম গঞ্জে তা একেবারেই অসম্ভব।
এইসব পরিসংখ্যান সামনে রেখে এবার ঈদে মানুষকে ঘরমুখী না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে যাতে শিল্প কারখানায় তিন দিনের বেশি ছুটি না দেয়া হয়। বুধবার জারি করা প্রজ্ঞাপনে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হয়, সকল সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারী অফিস এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঈদের ছুটিতে আবশ্যিকভাবে স্ব-স্ব কর্মস্থলে অবস্থান করতে হবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলমান বিধিনিষেধের মেয়াদ আগামী ১৬ মে পর্যন্ত বাড়িয়ে সরকার বলেছে, ঈদের ছুটিতে সবাইকে যার যার কর্মস্থলের এলাকাতেই থাকতে হবে এবার। কিছু শর্তে গণপরিবহন চলার অনুমতি দিয়ে চলমান লকডাউন বাড়ানোর এই প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় আগে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তার সঙ্গে নতুন কিছু শর্তযুক্ত করে এর মেয়াদ ১৬ মে মধ্যরাত পর্যন্ত বাড়ানো হল। মহামারীর মধ্যে ঈদ-উল-ফিতর ঘিরে এবার কোন প্রতিষ্ঠানও কর্মীদের অতিরিক্ত ছুটি দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে পালন নিশ্চিত না করলে দোকানপাট ও শপিংমল বন্ধ করে দেয়া হবে। মাস্ক ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চলতি মাসে লকডাউন দেয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আগে জীবন তারপর অন্যকিছু। জীবন বাঁচিয়ে চালু করতে হবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। এজন্য বাইরে বের হলে কঠোরভাবে মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউ মোকাবেলায় যেখানে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমাদের অবস্থা কি হবে এটি বুঝতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বার বার বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে। তৃতীয় ঢেউ এলে কারও কিছুই করার থাকবে না। এজন্য তিনি সবাইকে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার পরামর্শ দেন। পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ করে কাউকে বাইরে বের হতে দেয়া হবেনা। বিধি ভঙ্গকারী যেই হোন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দেন।
সরকারের ঘোষণা বাস্তবায়নে গত কয়েকদিন ধরে শপিংমল ও হাট-বাজারে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। রাজধানীতে স্বাস্থ্যবিধি না মানায় একটি মার্কেট বন্ধ করে দেয়া হয়। জরিমানা করা হয়েছে দোকানের মালিক, কর্মচারীসহ সাধারণ ক্রেতাদের। ঈদের কেনাকাটা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের তীব্রতাও বাড়ানো হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালত কয়েকটি মার্কেটে অভিযান চালিয়েছে। এ সময় স্বাস্থ্যবিধি না মানার অভিযোগে রাজধানীর পল্টনে চায়না টাউন মার্কেট বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে কয়েক ঘণ্টা পর মার্কেটটি খুলে দেয়া হয়েছে। এদিকে নিউমার্কেট ও বসুন্ধরা মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি না মানায় অর্ধ শতাধিক ব্যবসায়ী ও ক্রেতাকে জরিমানা করেছে ডিএমপির ভ্রাম্যমাণ আদালত। দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, মাস্ক নিশ্চিত না করলে মার্কেট বন্ধ করে দেয়া হবে বলে আগেই সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। অন্য কোন মার্কেটও যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানে, সেগুলোও বন্ধ করে দেয়া হবে। আমরা সবসময় চেয়েছি মার্কেট খুলে দিতে। তবে মার্কেট খোলার আগে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার শর্ত দেয়া ছিল। এখন তা মেনেই ব্যবসা চালাতে হবে। কেউ তা না পারলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হবে।