বাবরুল হাসান বাবলু, তাহিরপুর থেকে :
ভারতের মেঘালয় রাজ্যে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটার ফলে তাহিরপুরে পাহাড়ি ঢলের বালিতে নষ্ট হচ্ছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি। আতংকিত হয়ে পড়ছে ২০টি গ্রামের ৪০ হাজার মানুষ। পাহাড়ি বালির আগ্রাসনে কয়েক বছরে শত শত ঘর বাড়ি উচ্ছেদ হয়েছে। নয়ন জুড়ানো ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়ের অসংখ্য ঝর্ণা তাহিরপুর সীমান্তে এক নতুন আতঙ্ক। বৃষ্টি নামলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এলাকার মানুষ কখন কোন দিকে ঢল নামে আর জনপদ ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
জেলার হাওর ও মেঘালয় সীমান্ত উপজেলা তাহিরপুর। বাদাঘাট ইউনিয়নের পুরান লাউড়েরগড় মনার পার(পাহাড়) থেকে উত্তরশ্রীপুর ইউনিয়নের বাগলি বীরেন্দ্রনগর পর্যন্ত ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের সীমান্ত রয়েছে ২০ কিলোমিটার। বাগলি, কলাগাঁও, চারাগাঁও, লাকমা, ট্যাকেরঘাট, বড়ছড়া, রজনী লাইন, চানপুর, কড়ইগড়া সহ অসংখ্য স্থানে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের ঝর্ণার সৃষ্ট ছোট বড় নালা বা ছড়া রয়েছে অর্ধশতাধিক। আর এ সমস্ত ঝর্ণার ছড়া দিয়ে বৃষ্টির দিনে পাহাড়ি ঢলের পানির সঙ্গে নেমে আসা বালি ও পাথরে দিন দিন ঢাকা পড়ছে ২০ কিলোমিটার সীমান্তের ৩টি ইউনিয়নের রাস্তাঘাট, ঘড়বাড়ি ও ফসলি জমি। ঢলের সঙ্গে নেমে আসা বালিতে নাব্যতা হারাচ্ছে হাওর নদী ও খালবিল। মানুষের বসবাস ও চাষবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে সীমান্ত জনপদের ২০ গ্রামের ৪০ হাজার মানুষের আবাদি জমি ও বাড়িঘর। আবার এসব বালির সঙ্গে রাসায়নিক তরলবর্জ্য প্রবাহিত হয়ে আসায় পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ ভারতের মেঘালয় পাহাড়ে অপরিকল্পিত কয়লা ও চুনাপাথর উত্তোলন। কয়লা খনিতে মাইনিং-এর মাধ্যমে খনিজ দ্রব্য উত্তোলনে ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে বলে স্থানীয় ও বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
তাহিরপুর সীমান্তে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে প্রথম বড় ধরনের পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এ সময় চানপুর বাজারের পশ্চিম দিকে নয়াছড়া এলাকায় মেঘালয় পাহাড় ধসে নেমে আসা বালি, কয়লামিশ্রিত কাদামাটি, বড় -বড় পাথরে মুহূর্তেই অসংখ্য ঘর বাড়ি ও বিপুল ফসলি জমি চাপা পড়ে। ভরাট হয়ে যায় ফসলি জমি ও পুকুর।
২০০৮ সালেই পরিবেশ বিপর্যয় রোধে কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সর্বস্ব হারানো ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবার। অন্যদিকে এ বিপর্যয় রোধে ২০০৮ সালের নভেম্বর সুনামগঞ্জ ১৭ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের পক্ষে ভারতের শিলং ৮৩ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের বৈঠক হয়। বৈঠকে অপরিকল্পিতভাবে ভারতের ফরেস্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী পাহাড় খোঁড়া বন্ধের জন্য বলা হয়।
একই বিষয়ে ভারতের পরিবেশবাদী সংগঠনও অপরিকল্পিত কয়লা ও চুনাপাথর উত্তোলন বন্ধে সোচ্চার হয়। তারা এ বিষয়ে তাদের দেশে এখনো আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই মাঝে মধ্যে ভারতের আদালতের নির্দেশে কয়লা উত্তোলন বন্ধ থাকে। এখনো বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, ২০০৮ সালের পর থেকে বছরে বছরে বর্ষাকালে পাহাড়ে বৃষ্টি হলেই ঢলের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত বালি, পাথর চলে আসে সেই সাথে তরল বর্জ্যও আসে। বৃষ্টির সময় প্রবল বেগে নেমে আসা ঢল ঠেকানো অসম্ভব। গত কয়েক বছরে সীমান্তের রজনী লাইন, চানপুর, কড়ইগড়া, রাজাই, লাকমা, কলাগাঁও সীমান্তে বালির আগ্রাসনে শতশত বাড়িঘর উচ্ছেদ হয়ে গেছে। বছরের পর বছর এ ভাবে নেমে আসা ঢলের সঙ্গে তরল বর্জ্য মিশ্রিত বালি আসার ফলে সীমান্তে উর্বর জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইতি মধ্যে সীমান্তে ২০ গ্রাম সহ আশপাশের ছোট বড় হাওরে পাহাড়ি ঢলের বালিতে চাপা পড়ে নষ্ট হয়ে পড়েছে ৫শ হেক্টর আবাদি জমি। এ সব জমিতে বর্তমানে ঘাসও জন্মে না। সেই সাথে বালির সঙ্গে এক ধরনের তরল রাসায়নিক বর্জ্য মিশ্রিত থাকায় এ বালি কিনতেও কেউ আগ্রহী নয়। পাশাপাশি বজ্য মিশ্রিত পানি ব্যবহারেও দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। এ পানি ব্যবহার করাও যাচ্ছেনা দৈনন্দিন কোন কাজে।
উত্তর বড়দল ইউনিয়নের রাজাই গ্রামের কৃষক আব্দুল মোতালেব তিনি বলেন, সীমান্ত গ্রামগুলো এক সময় কৃষি নির্ভর ছিল। বালি পরে আবাদি জমিগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এখন তাদের বিকল্প কর্মস্থান খুঁজতে হচ্ছে।
উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের লাকমা গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া তিনি বলেন, পাহাড়ি ঢলের পানিতে বালি আসায় ফসলি জমির সাথে-সাথে বাড়ি ঘরও নষ্ট হচ্ছে। বাড়ি ঘরেও কোন প্রকার গাছপালা লাগানো যাচ্ছে না।
উত্তর বড়দল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কাশেম তিনি জানান, ২০০৮ সালে চানপুর নয়া ছড়া দিয়ে বড় রকমভাবে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে, আমরা জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আহবান জানিয়েছিলাম আমাদের সীমান্ত গ্রামগুলোকে বালির আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্য। এখনও সরকারের কাছে আহবান জানাই আমাদেকে বালির আগ্রাসন থেকে রক্ষা করুন।
তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, বালি পড়ে আবাদি জমিগুলো একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর ঐ জমিগুলোতে কোন ফসল ফলানো যাচ্ছে না।
তাহিরপুর বাদাঘাট ইউনিয়নের বাসিন্দা ও জেলা পরিষদ সুনামগঞ্জ এর সদস্যা সেলিনা বেগম বলেন, সামান্য বৃষ্টিতেই পাহাড়ি নালা দিয়ে পানির সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত বালি আসে। এখনই এর স্থায়ী উদ্যোগ গ্রহণ করা খুব জরুরী।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, ঢলের বালিতে দিন দিন আবাদি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে, এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে সমস্যা আরো প্রকট হবে।