আল-হেলাল সুনামগঞ্জ থেকে :
আবু আলী সাজ্জাদ হোসেইন এডভোকেট সম্পাদিত ১৯৯৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত, “সুনামগঞ্জ জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য” নামের গবেষণামূলক ঐতিহাসিক গ্রন্থের ১৫৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়, “বাবু কালীচরণ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য ৭২ বছর পর সংগ্রহ করা সম্ভব না হলেও তার নাম আজো সবার জানা। তার কান্ড কারখানা এখানে প্রবাদের মত রয়ে গেছে। তাঁকে এখানকার রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিবর্গ ও কংগ্রেস কর্মীরা আসাম প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য পদে দাড় করিয়ে দিয়েছিলেন (বৃটিশ শাসন ও তাদের দেয়া সীমিত নির্বাচনের বিরোধিতা করে)। ভাগ্য গুনে তিনি স্বতন্ত্র রিজার্ভ আসন থেকে পাশ করেছিলেন। কিন্তু একজন এমএলএ এর দায়িত্ব পালনের মত না ছিল তার অভিজ্ঞতা না ছিল শিক্ষাগত যোগ্যতা। তবে তিনি ভাগ্য একখানা নিয়ে জন্মেছিলেন বটে। তাঁর কাজে সহযোগিতা করার জন্য সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয় বাবু লালা নিরেন্দু দে বুলি বাবু মোক্তার মহাশয় কে। এদের উভয়েই বর্তমানে বেঁচে নেই”।
কিন্তু সুনামগঞ্জের রাজনীতির প্রবাদ এই পুরুষটি অনেক আগে প্রয়াত হলেও তার বংশধররা এখনও তার স্মৃতি অবদানকে স্মরন করেন। তাঁর সাথে ১৯২২ সালে আসাম প্রাদেশিক পরিষদে আরো যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন তারা হচ্ছেন,রায় বাহাদুর অমরনাথ রায়,রায় সাহেব প্যারীমোহন দাশ ও মৌলভী মুনাওর আলী প্রমুখ। তৎকালীন সময়ে সুনামগঞ্জের শীর্ষ জনপ্রতিনিধি হিসেবে তারা দূর্দন্ড প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী হলেও আসাম আইনসভার এমপি বাবু কালিচরন রবি দাস (কালিচরন মুচি) ছিলেন স্বভাবতই সরজ সরল সাদাসিদা নরম মেজাজের নিরহংকারী মানুষ। এমপি নির্বাচিত হলেও অতি সাধারনের মতোই ছিল তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
সরজমিনে অনুসন্ধানে গিয়ে জানা যায়,বাবু কালিচরন রবি দাস (কালিচরন মুচি) সুনামগঞ্জ মহকুমার তাহিরপুর থানার আনোয়ারপুর নয়াহাট গ্রামে ১৮৯০ সালে জন্মগ্রহন করেন। মৃত্যুবরন করেন ১৯৫২ সালে। তার পিতার নাম ক্ষুদিরাম রবি দাস। ভারতের আজমগর জেলায় ছিল তার পূর্ব পুরুষের বসবাস। তার ছোট ভাই মহাবীর রবি দাস। কালিচরন মুচি ৪ পুত্র ও ১ কন্যার জনক ছিলেন। তন্মধ্যে সিও নারায়ন রবি দাস,মেজো ছেলে মাখন রবি দাস,কাপ্তান রবি দাস আনোয়ার নয়াহাট গ্রামেই লোকান্তরিত হন। জেষ্ট পুত্র দেশভাগের আগেই ভারতে চলে যান এবং সেখানেই লোকান্তরিত হন। একমাত্র কন্যা পিয়ারী রবি দাস বৈবাহিক সূত্রে বিশ্বম্ভরপুর থানার দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের বাঘমারা কাইলাকান্দি গ্রামে বসবাস করতেন এবং সেখানেই লোকান্তরিত হন একমাত্র পুত্র রুপলাল রবি দাসকে রেখে। পিয়ারী রবি দাসের বিয়ে হয় কাইলাকান্দি নিবাসী বদূরাম রবি দাসের সাথে। পিয়ারী রবি দাসের পুত্র রুপলাল রবি দাস (বয়স-৬০) এর ২ পুত্র ছুনু রবি দাস ঢাকায় এবং ছোট ছেলে বিষ্ণু রবি দাস বিশ^ম্ভরপুরের কাটাখালি বাজারে সেলুন ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে। রুপলাল রবি দাসের ২ কন্যার মধ্যে একজনের বিয়ে হয় বালিজুরী গ্রামে এবং অপরজন জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনা বাজারে।
কালীচরন রবি দাসের সহোদর মহাবীর রবি দাস ২ পুত্র ও ৩ কন্যার জনক। মহাবীর রবি দাসের ২ পুত্র যথাক্রমে কাপ্তান রবি দাস ও শিবনারায়ন রবি দাস। তন্মধ্যে শিব নারায়ন রবি দাস ২ পুত্র ও ৩ কন্যার জনক। এরা হচ্ছেন সুবাস রবি দাস ও সুরেশ লাল রবি দাস। কন্যাদের মধ্যে কেউলি রবি দাসের বিয়ে হয় সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের টুকেরঘাট গ্রামের সুরেশ লাল রবি দাসের সাথে। ২য় কন্যা আমরতি দাসের বিয়ে হয় দোয়ারাবাজার উপজেলার নুরপুর গ্রামের পুতুল রবি দাসের সাথে এবং কনিষ্ট কন্যা পার্বতী রবি দাসের বিয়ে হয় জামালগঞ্জ উপজেলার গোলামীপুর গ্রামের সূর্যময় রবি দাসের সাথে। সুরেশ লাল রবি দাসের একমাত্র ছেলে সঞ্জয় রবি দাস বসবাস করে তাহিরপুর উপজেলার বালিজুড়ি ইউনিয়নের আনোয়ারপুর নয়াহাটে। কালিচরন রবি দাসের ভাতিজা অর্থাৎ মহাবীর রবি দাসের ২য় পুত্র কাপ্তান রবি দাস ২ পুত্র ও ৪ কন্যার জনক। এরা হচ্ছেন লাল বাহাদুর রবি দাস ও বাবন রবি দাস। তন্মধ্যে বাবন রবি দাস স্বপরিবারে বসবাস করেন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের বীটগঞ্জ গ্রামে। আনোয়ারপুর নয়াহাটে লাল বাহাদুর রবি দাসের রয়েছে ১ ছেলে ও ২ মেয়ে। একমাত্র ছেলে সাগর রবি দাস লেখাপড়া করে আনোয়ারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণিতে। জেষ্ট কন্যা শাপলা রবি দাসের বিয়ে হয় দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া নিবাসী নয়ন রবি দাসের সাথে। কনিষ্ট কন্যা রুপালী রবি দাস নয়াহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে।
কালীচরন রবি দাসের ভাই মহাবীর রবি দাসের পুত্র শিব নারায়ন রবি দাসের পুত্র সুবাস রবি দাস ২ পুত্রের জনক। এরা হচ্ছে চঞ্চল রবি দাস ও সজল রবি দাস। তন্মধ্যে চঞ্চল রবি দাস আনোয়ারপুর বাজারে একটি সেলুন ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছে। সজল রবি দাস অধ্যয়ন করছে দক্ষিণকুল মডেল হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে।
কালিচরন রবি দাসের দৌহিত্র রুপলাল রবি দাস বলেন,আনোয়ারপুর নয়াহাট গ্রামে আমাদের পুর্ব পুরুষদের প্রায় ৭০/৮০ বছরের বসতি। আমার নানা বাবু কালিচরন মুচিকে এই এলাকার মানুষ প্রথমে ভোট দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার বানায়। তখন ঐ এলাকায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যা খুব কম ছিল। সমগ্র ইউনিয়নে ভোটারের সংখ্যা ছিল মাত্র ১২০ জন। ভোটারদের ভোটাধিকারের যোগ্যতা ছিল ৬ষ্ঠ শ্রেণি পাশ। বাবু কালিচরন রবি দাস শিক্ষিত হওয়ার কারণে তিনি মেম্বার পদে প্রার্থী ও নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। পরে সাহস করে এমপি পদে প্রার্থী হয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসামের আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি কংগ্রেস দলের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
কালিচরন রবি দাসের সহোদর মহাবীর রবি দাসের পুত্রবধু শিব নারায়ন রবি দাসের স্ত্রী বাসন্তি রবি দাস নামের এক বিধবা বৃদ্ধাকে পাওয়া যায় নয়াহাট গ্রামে। কিভাবে তারা জীবিকা নির্বাহ করছেন জানতে চাইলে বাসন্তি রবি দাস বলেন,এখন শুধু মুচিগিরী করে আমাদের চলেনা। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে জুতা সেলাইয়ের পাশাপাশি,সেলুন দিয়ে চুল কাটা,মদ বিক্রি ও দিনমজুরী করে চলতে হয়। তবে আমরা স্বাধীন এই দেশের নাগরিক হলেও আমাদের বেলায় বঞ্চনা বৈষম্যের শেষ নেই। লেখাপড়া করলেও আমাদের সন্তানদের চাকুরী হয়না। বিপদে আপদে আমরা সরকার প্রশাসনের সহযোগীতা পাইনা। তারপরও এই দেশকে আমরা ভালবাসি।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টি হচ্ছে তারা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বাংলা ভাষা জানে বুঝে ও এই ভাষায় কথা বলে। কিন্তু মাতৃভাষা হিসেবে সিলেটের প্রাচীন নাগরি ভাষা কেও তারা মাতৃভাষা হিসেবে চর্চা করে আসছে। যে ভাষায় সৈয়দ শাহনূর গান লিখেছেন। বাংলাভাষার আদি কবি ও সাহিত্যিকদের এই ভাষাই এমপি কালিচরন মুচির বংশধরদের মায়ের ভাষা। আনোয়ারপুর নয়াহাট গ্রামের যে বাড়িতে এমপি কালিচরন মুচি বসবাস করতেন সেই বাড়িটি এখনও আছে। তবে তার পরিবারের লোকসংখ্যা খুব কম। হাতেগনা মাত্র ৯ জনের বেশী হবেনা। তারপরও স্বগর্বে ঠিকে আছে এই পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের মাঝে নাগরী ভাষা।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুনাসিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন,আসামের নির্বাচিত এমপি বাবু কালিচরন মুচি আমার উপজেলার গৌরব ও অহংকারের নাম। আমরা ভাষা সৈনিক ও যুক্তফ্রন্ট এর এমপি অধ্যাপক শাহেদ আলী ও সাবেক এমপি আব্দুজ জহুর সাহেবকে যেভাবে শ্রদ্ধা ও স্মরণ করি তাকেও ঠিক তেমনিভাবেই স্মরণ করবো। কেননা তিনি ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী একজন মানুষ। অসাম্প্রদায়িকতার কারনেই এই অঞ্চলের হিন্দু মুসলিম জাতি ধর্ম বর্ণ গোত্র ভেদাভেদ ভূলে সবাই তাকে মেম্বার থেকে এমপি পর্যন্ত নির্বাচিত করেছে। তাকে মূল্যায়ন করলেই মানুষকে মূল্যায়ন করা হবে বলে আমি মনে করি।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এরশাদ মিয়া,৯নং ওয়ার্ডের বাঘমারা গ্রামের মেম্বার সোহেল মিয়া,তাহিরপুরের বালিজুরী ইউনিয়নের মেম্বার বাবুল মিয়া বলেন,বর্তমানে দুটি আলাদা উপজেলায় বসবাস হলেও এমপি কালিচরন মুচির পরিবারবর্গরা সম্প্রীতির সাথেই আমাদের এলাকায় বসবাস করছে। এবং তাদের প্রতি আমাদের আলাদা দৃষ্টি রয়েছে। এলাকাবাসী দেশব্যাপী চলমান করোনা ভাইরাসের ফলে লকডাউন পরিস্থিতির করুন পরিণতির শিকার আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সাবেক এমএলসি বাবু কালিচরন রবি দাসের অসহায় পরিবারটির পাশে তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুর নয়াহাট ও বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার কাইলাকান্দি গ্রামে গিয়ে এই দুর্দিনে তাদেরকে খাদ্য সহায়তাসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদানের জন্য সরকার প্রশাসন ও বিত্তবানদের প্রতি উদাত্ত আহবাণ জানিয়েছেন।