ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী ॥ জিয়া-এরশাদ-খালেদা সবাই ৭ মার্চের ভাষণ বাজাতে বাধা দিয়েছে

19
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষে সকল গৃহহীন মানুষকে ঘর নির্মাণ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, মুজিববর্ষে দেশের কোন মানুষ গৃহহীন থাকবে, এটা হতে পারে না। এই মুজিববর্ষের ভেতরেই এই বাংলার মাটিতে কোন মানুষ গৃহহীন থাকবে না। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও জাতির পিতার আদর্শের সৈনিকদের প্রতি অনুরোধ, এই কথাটা দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। খুঁজে দেখুন, কারা গৃহহীন রয়েছেন, কাদের থাকার জায়গা নেই। দেশের বিত্তবান, অর্থশালী এবং মুজিব আদর্শের সৈনিকরা চেষ্টা করুন গৃহহীনদের ঘর করে দিতে। না পারলে সরকারীভাবে কিংবা বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে টাকা দেব ঘর করার জন্য। সবাইকে ঘর করে দেয়া হবে। মুজিববর্ষে এটি করতে পারলে সেটাই হবে আমাদের বড় স্বার্থকতা।
জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া সব আমলেই জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধ থাকার কথা উল্লেখ করে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া সবাই ৭ মার্চের ভাষণ বাজাতে বাধা দিয়েছে। কিন্তু সত্যকে কোনদিন মুছে ফেলা যায় না। সত্য আজ উদ্ভাসিত হয়েছে। যে ভাষণ তারা নিষিদ্ধ করেছিল, সেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। যারা এই ভাষণ নিষিদ্ধ করেছিল তারা লজ্জা পায় কিনা জানি না। লজ্জা-শরম থাকলে তারা বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করতে পারত না।
শনিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তী দীর্ঘ একুশটি বছর ইতিহাস বিকৃতির কথা তুলে ধরে বলেন, দীর্ঘ ২১টি বছর যারা ক্ষমতায় ছিল তারা বারবার ইতিহাস বিকৃত করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। সত্যিই বাঙালীকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি। আর সত্যকে কখনও কেউ মুছে ফেলতে পারে না, মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। সেই সত্যই আজ উদ্ভাসিত হয়েছে।
পঁচাত্তর পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি এবং জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বানানোর অপচেষ্টার প্রসঙ্গ তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, এদেশে এমন একটা সময় ছিল যখন ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম অবদান সেটাও মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। এমনভাবে বিকৃত ইতিহাস তৈরি করা হলো, যেন কোন এক মেজর বাঁশিতে ফুঁ দিল, অমনি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, আর দেশ স্বাধীন হয়ে গেল! অথচ তিনি (জিয়াউর রহমান) নিজেই মুক্তিযুদ্ধের সময় ৪শ’ টাকা বেতনের চাকরি করতেন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে। তাকেই ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বানানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু কোন মেজরের বাঁশির ফুঁতে দেশ স্বাধীন হওয়া সম্ভব নয়- সেই সত্যই উদ্ভাসিত হয়েছে। আজকে সে সত্যটা মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় সূচনা বক্তব্য রাখেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আলোচনায় অংশ নেন দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিম-লীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, লে. কর্নেল (অব) মুহাম্মদ ফারুক খান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য পারভীন জামান কল্পনা, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী ও উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এস এ মান্নান কচি। অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন দেশের বিশিষ্ট আবৃত্তিকার শিমুল মোস্তফা। কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ ও উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুর ইসলাম আমিনের পরিচালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে মুজিববর্ষের মধ্যে বাংলাদেশকে ভূমিহীন-গৃহহীন- অসহায় মানুষকে মুক্ত করতে দলের নেতাকর্মীদের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, আওয়ামী লীগসহ সকল সহযোগী-ভাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতাকর্মী ও মুজিব আদর্শের সৈনিকদের কাছে এটা আমার একটা আবেদন। সবার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, একটা কাজ যদি আপনারা করেন এর থেকে বড় স্বার্থকতা আর হবে না। আমি সেই কাজটাই আপনাদের দিতে চাই। আমি চাই মুজিববর্ষ আমরা উদ্যাপন করছি, এই মুজিববর্ষের ভেতরেই বাংলাদেশে একটা মানুষও গৃহহীন থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখনও আমাদের দেশে নদীভাঙ্গা মানুষ গৃহহারা হয়ে যায়, এখনও আমাদের দেশে কিছু মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় যারা ভূমিহীন, গৃহহীন। তাই সারাদেশের নেতাকর্মীর প্রতি আমার অনুরোধ- আওয়ামী লীগের এত নেতাকর্মী, এত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক- আপনারা যার যার নিজের গ্রামে, নিজের এলাকায় একটু খোঁজ নেন যে, আপনার এলাকায় কয়টা মানুষ গৃহহীন আছে। কয়টা মানুষ গৃহহারা আছে, ভূমিহীন আছে। আপনারা একটু খুঁজে বের করেন। তাদেরকে আমরা ঘর করে দেব। আপনারা পয়সা খরচ করতে না পারলে আমি দেব। কিন্তু তাদের আমরা ঘর দিয়ে যেতে চাই।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমার এই কথা পৌঁছে দেবেন সারা বাংলাদেশে। আপনাদের কাছে এটা আমার দাবি। যে খরচ করতে পারবে না সেখানে আমি টাকা দেব। যেভাবে পারি দেব। যারা অর্থশালী, সম্পদশালী, বিত্তশালী আছে তারা তো পারবেন। এই বাংলার মাটিতে কোন মানুষ ভূমিহীন, গৃহহীন থাকবে না। আমি সারা বাংলাদেশে মুজিব আদর্শের প্রতিটি নেতাকর্মীর কাছে এই আহ্বানটাই রাখব যে, আমরা মুজিববর্ষ উদ্যাপন করছি। বাংলাদেশে কোন মানুষ গৃহহীন থাকবে মুজিববর্ষে, এটা হতে পারে না। এই মুজিববর্ষের ভেতরেই বাংলাদেশের একটা মানুষও গৃহহীন থাকবে না।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য জাতির পিতা সংগ্রাম করেছেন কেন? তিনি বার বার কি বলেছেন? বঙ্গবন্ধু বলেছেন – আমার জীবনের একমাত্র কামনা বাংলার মানুষ যেন অন্ন পায়, বস্ত্র, উন্নত জীবন পায়। পাশাপাশি তিনি বলেছেন বাংলাদেশের মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এই মৌলিক চাহিদাগুলো তিনি নিশ্চিত করতে চান। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সে আকাক্সক্ষা আমরা পূরণ করতে চাই। আমরা তা করে যাচ্ছি। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প, আমরা আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়েছি। গৃহহীনদের জন্য গৃহায়ন প্রকল্প নিয়েছি। যার জমি আছে তাকে ঘর করে দিচ্ছি, দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে দুর্যোগ সহনীয় ঘর করে দিয়েছি। সরকারীভাবে আমরা এসব প্রোগ্রাম নিয়েছি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে ভাষণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যাপরবর্তী দীর্ঘদিন এ দেশে নিষিদ্ধ ছিল, এখন তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিলে স্থান করে নিয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ গত আড়াই হাজার বছরের যত ভাষণ, যত সামরিক-অসামারিক নেতারা দিয়েছেন- তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যে ভাষণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে স্বাধীনতার চেতনায়। এভাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণ।
প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, যারা এই ভাষণ মুছে ফেলতে চেয়েছিল, নিষিদ্ধ করে রেখেছিল- আমি জানি না তারা লজ্জা পায় কিনা। অবশ্য তাদের লাজ-লজ্জা আছে বলেও মনে হয় না। থাকলে তো এটা করতে পারত না। যদি নির্লজ্জই না হবে তবে এই ভাষণ বা তাঁর (বঙ্গবন্ধু) নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করে কেউ। করতে পারে না। যে ভাষণ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই ভাষণই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট এবং ওই সময় তাঁর মা বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা বাঙালী জাতির জন্য সবচেয়ে সময়োপযোগী ঘোষণাটিই দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে অনেকে অনেক কথাই বলেছেন। আমি শুধু বলব- বঙ্গবন্ধুর ভাষণের একেকটি লাইন একেকটি কোটেশন। আর সেই লাইনগুলো ছিল সেই সময়ের জন্য প্রযোজ্য। সময়ের প্রয়োজনে জাতির সামনে যা কিছু বলার প্রয়োজন ছিল, বঙ্গবন্ধু সেদিন তা বলে গেছেন তাঁর ভাষণে।
ঐতিহাসিক সেই ভাষণ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পটভূমি হয়ত অনেকেই জানেন। ওই সময় অনেকে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন। অনেক জ্ঞানী-গুণীজন লিখিত আকারে ভাষণ তৈরি করে দিয়েছিলেন। আমাদের ছাত্রনেতারা, তাদের অনেকেই পরে আর আমাদের সঙ্গে থাকেনি; তারা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন এখনই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হবে, নইলে জাতি হতাশ হবে। কিন্তু জাতির পিতা জানতেন, কখন কোন্ পদক্ষেপটি নিতে হবে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে দেশের মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য তৈরি হওয়ারই নির্দেশ দিয়েছিলেন। সকলকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে এবং দেশে একটি গেরিলা যুদ্ধ হবে। সেখানে কার কী দায়িত্ব সে কথাও তিনি বলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, কেন এমন কৌশলী ঘোষণা দিতে হলো বঙ্গবন্ধুকে? সে প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, তখনকার যে অবস্থা, অনেক খবরই আমরা জাতির পিতার পরিবারের সদস্য হিসেবে পেতাম, যা বাইরের মানুষের জানার কথা না। ওই সময় পাকিস্তানীরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। তাদের যুদ্ধ বিমান ও হেলিকপ্টার তৈরি ছিল। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কী বলবেন, সে অনুযায়ী এ্যাকশন প্লানও তৈরি ছিল পাকিস্তানীদের। ব্রিটিশ আমলে যেমন জালিয়ানওয়ালাবাগে নৃশংস হত্যাকা- ঘটিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছিল, ঠিক ওই রকম প্রস্তুতিই ছিল পাকিস্তানীদের। তাই জাতির পিতাকে কৌশলী হতে হয়েছে।