কাজিরবাজার ডেস্ক :
কবি শামসুর রাহমান ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ কবিতায় ‘বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও/আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ/বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে/সালামের মুখ আজ উন্মথিত মেঘনা/সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা/সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।’ এই কবিতার মধ্যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনই যে স্বাধীনতার প্রেরণা, তা বুঝতে কারোরই সংশয় নেই। সবাই বুঝে নিয়েছে ৫২ থেকে ৭১ ভাষা থেকে স্বাধীনতা। পাকি শাসকগোষ্ঠীর শাসন শোষণের হাত থেকে মুক্তিলাভ।
মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায় ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন ও ধীরেনন্দ্রনাথ দত্ত, ১১ মার্চ পূর্ববঙ্গে সাধারণ ধর্মঘট, খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে ৮ দফা চুক্তিনামা স্বাক্ষর, ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সভা, ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব, ঢাকায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-রেসকোর্স ময়দান ও সমাবর্তন ভাষণ প্রদান, জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন, বর্ণমালা সব কমিটি গঠন ও আরবী হরফ প্রবর্তনের নিন্দা। শ্রেণী-পেশার মানুষের সংগ্রাম ও বিভিন্ন সংগঠনের ভূমিকা বড় হয়ে ওঠে। গোলাম কুদ্দুছ তার ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন, উর্দু প্রচলন ও আরবী হরফে বাংলা লেখার অপচেষ্টা, ঢাবি রাষ্ট্র সংগ্রাম কমিটি গঠন, চট্টগ্রামে চারদিনব্যাপী সাংস্কৃতিক সম্মেলন, পূর্ব বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা ধর্মঘট, শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি নির্ধারক কমিটি গঠন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠন, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে সমাবেশ ও মিছিল, মেডিক্যাল স্কুল ছাত্রদের আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনে জনমত সৃষ্টি ও ভিন্নমতকে শাণিত যুক্তিতে মোকাবেলা করা ও শাসকগোষ্ঠীর দম্ভকে নস্যাৎ করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গোলাম কুদ্দুছ তার বইতে উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পূর্ববাংলা সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে এ সময় দ্বিধাবিভক্তি লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে তমদ্দুন মজলিশের আহ্বায়ক অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেন, মন্ত্রীদের মধ্যে তখন রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে দুটি দলের সৃষ্টি হয়। একটি তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ও হামিদুল হককে কেন্দ্র করে, এরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধী। অপর দলটি ছিল হাবিবুল্লা বাহার ও আফজাল সাহেবসহ আরো দু’একজন মন্ত্রীকে নিয়ে। পূর্বেই বলেছি এরা গোপনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সমর্থন করতেন। ফজলুল হক হলের সভাতেই প্রথম আমার বিশেষ অনুরোধে হাবিবুল্লা বাহার সাহেব কয়েকজন মন্ত্রীসহ অংশগ্রহণ করেন এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ‘যথাযোগ্য মর্যাদা’ দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন তাদের বক্তব্য তখনকার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে রাজনৈতিক কারণে তারা নিশ্চুপ হয়ে যান।
বশির আল হেলাল তার লেখা ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আমাদের জাতীয়তার স্বরূপ নির্ণিত হয়নি। পাকিস্তান হাসিলের আগে আমরা দ্বিজাতিতত্ত্বের দর্শন কাজে লাগিয়েছি। কিন্তু পরে সেটা বাতিল করেছি। ঐতিহাসিক বিচারে আমাদের একটা নিষ্ঠুর কূটাভ্যাস হচ্ছেঃ ঐতিহ্যের বিশ্লেষণের নির্ণায়ক-রূপে সমাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়নকে আমরা বৈজ্ঞানিক ও যথার্থ পদ্ধতি বলে প্রায়াশ স্বীকার করি বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ইতিহাসের ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বগুলোকে নিয়েই অগ্রসর হতে হয়। আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতির ইতিহাস যেটুকু লেখা হয়েছে মোটামুটি সেভাবেই লেখা হয়েছে। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় অতি জটিল।
পাকিস্তান আন্দোলন ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের সময় থেকে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত পূর্ব বাংলার জনসাধারণের মনে ভবিষ্যত স্বাধীন আবাসভূমি ঘিরে অনেক স্বপ্ন জেগেছিল। এক শোষকের বদলে আর কোন শোষণকে, এক অত্যাচারীর বদলে আরেক অত্যাচারীকে তারা ক্ষমতায় বসাচ্ছে- এ কথা তারা তখন ভাবতেও পারেনি। অন্যায়মুক্ত, অভাবমুক্ত, প্রেমপ্রাচুর্য ঐশ্বর্যমন্ডিত নতুন জীবনের স্বপ্নই তাদের একদা পাকিস্তান আন্দোলনে আকৃষ্ট করেছিল।
ব্রিটিশ সরকার বিদায় করে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদার প্রথার উচ্ছেদ ঘটিয়ে কৃষক জনতার জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করে নতুন দেশে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা সুখী-সুন্দর নতুন জীবন সৃষ্টি করার প্রতিশ্রুতি মুসলিম লীগের নাজিমউদ্দিন-আকরম খাঁনবিরোধী অংশও মানুষের মনে নতুন আশা-আকাক্সক্ষা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে তখন বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। বলাবাহুল্য এ অঞ্চলে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনী প্রচার ও পরিচালনার নেতৃত্ব ছিল সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের হাতে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, নিখিল ভারত কিষাণসভা, শেরেবাংলা ফজলুল হক পরিচালিত কৃষক-প্রজা পার্টি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের আন্দোলনের ফলে কৃষিপ্রধান পূর্ব বাংলার কৃষক জনতার মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল। এ আন্দোলনের পরই চলে আসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩)। যে অর্থনৈতিক দুর্দশার সৃষ্টি করেছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তা আরও তীব্রতা লাভ করতে থাকে। দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। পূর্ব বাংলায় ১৯৪৮, ’৪৯, ’৫০ ’৫১ সালে দুর্ভিক্ষ, অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে বিলাসিতার জীবনযাপন। এ পরিস্থিতিতেই পূর্ব বাংলার হাজার কণ্ঠে সেøাগান উঠে ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়-লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’ আর ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি।
পাকিস্তান সৃষ্টির আগ থেকেই পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের একটা প্রভাব চরম আকারেই ছিল। কারণ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছিল। অবশেষে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই পাকিস্তানীদের আসল চেহারা ফুটে উঠে। কৃষিপ্রধান পূর্ব বাংলার কৃষক জনতার জীবন ছিল বহু সমস্যায় আকীর্ণ। সেগুলোর প্রতি কোন দৃষ্টি ছিল না মুসলিম লীগ সরকারের। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানী শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ গড়ে উঠে এই বঙ্গে। অবশ্য এর আগে পাকিদের বিরুদ্ধে রাজশাহীর নাচোল বিদ্রোহ, ময়মনসিংহের টঙ্ক প্রথাবিরোধী বিদ্রোহ, সিলেটের নানকার প্রথাবিরোধী বিদ্রোহ হয়েছে।
পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কতগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন ঘটনা এ আন্দোলনের ঐতিহাসিক মূল্য ও তাৎপর্যকে কখনই সঠিক করে তুলে ধরতে পারে না। বস্তুতপক্ষে পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন তৎকালীন রাজনীতির সঙ্গে একই গ্রন্থিতে অবিচ্ছিন্নভাবে গ্রথিত। সেই অনুসারে পরস্পরের সঙ্গে নিবিড় ও গভীরভাবে একাত্ম। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসেবে ভাষা আন্দোলনের মুখ্যত দৃষ্টি পর্যন্ত ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ। এই দুই পর্যায়ের আন্দোলনের সচেতনতা, ব্যাপকতা, সাংগঠনিক তৎপরতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে তারতম্য এত বেশি যে, প্রথম দৃষ্টিতে তারতম্যকে মনে হয় গুণগত। ১৯৪৮ আর ১৯৫২ সালের মধ্যকার এই তফাত বুঝতে হলে মধ্যবর্তী চার বছরের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির খতিয়ান সম্ভব নয়। ’৪৮ সালের আন্দোলনের সঙ্গে বায়ান্ন সালের আন্দোলনের এই পার্থক্য বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে হলে এই অন্তর্র্বতীকালীন পূর্ব বাংলার ব্যাপক জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে যা কিছু ঘটেছিল এবং তার ফলে যে পরিবর্তন সমগ্র পরিস্থিতির মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল, তা ভালভাবে জানা দরকার। পরিস্থিতির এই বিবরণের সঙ্গে পরিচিত হলে দেখা যাবে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন মুষ্টিমেয় ছাত্র শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীর আন্দোলন নয়, তা শুধু শিক্ষাগত অথবা সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না। বস্তুতপক্ষে তা ছিল পূর্ব বাংলার ওপর সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার পাকিস্তানী শাসক ও শোষক শ্রেণীর জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি বিরাট ও ব্যাপক গণআন্দোলন।
বদরুদ্দীন উমরের লেখা ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি-১’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যবস্থাপক সভায় খাজা নাজিমুদ্দীন সরকারী প্রস্তাব রাখেন ’৪৮ সালের ৬ এপ্রিল। সে দিনের সভায় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমমুদ্দীন বাংলাকে সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি সেদিন নাজিমুদ্দীন আদপে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। ওই প্রস্তাবের পর ব্যবস্থাপক সভায় কংগ্রেস নেতা বসন্ত কুমার দাস স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আগের দিন খাজা নাজিমুদ্দীন একটি নোটিস মারফত জানিয়েছিলেন যে, তিনি সেদিন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করবেন, কিন্তু তার প্রস্তাবের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনকিছু উল্লেখ করেননি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবকে সরকারী প্রস্তাব বলেই মনে হয় এবং সেটা নিশ্চয় সরকারীদলের অনুমোদনও লাভ করেছে। বসন্ত দাস প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য সময় প্রার্থনা করে বলেন, এ বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব আনার অধিকার তাদের আছে এবং তার আগে মূল সরকারী প্রস্তাবটি তাদের পার্টি মিটিংয়ে আলোচিত হওয়া প্রয়োজন।