দেশী-বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে ভোক্তা অধিদফতরের বৈঠক ॥ ঝলমলে রঙিন বিজ্ঞাপন কমিয়ে সাবান-শ্যাম্পুর ও টুথপেস্টের দাম কমান

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ঝলমলে রঙিন বিজ্ঞাপন কমিয়ে ভোক্তা স্বার্থে সাবান-শ্যাম্পু ও টুথপেস্টের মতো নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম কমানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছে। গত ছয় মাসে দেশে সাবান-শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট, ভিমবার, পারফিউম, ক্রিম ও টয়লেট্রিজ পণ্যের দাম ৫০ থেকে শতভাগ পর্যন্ত বেড়েছে। মূলত আড়াই বছর আগে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে সব ধরনের ‘ক্লিনার আইটেমের’ দাম বাড়তে শুরু করে।
সর্বশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলো নিয়মনীতি ছাড়াই ট্রয়লেট্রিজ পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। আয় না বাড়লেও নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় কষ্ট বেড়েছে মানুষের। এ অবস্থায় এসব পণ্যের দাম কমানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে কম দামে বিক্রি করার পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ, দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলো যেভাবে রঙিন বিজ্ঞাপন প্রচার করছে এতে তাদের উৎপাদন খরচ আরও বাড়ে। টেলিভিশন খুললেই বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। রঙিন ছবি! এসব না করে বরং ভোক্তাদের দিকে বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন। নিত্যব্যবহার্য এসব জিনিসের দাম বাড়ায় সাধারণ ভোক্তারা কষ্টে আছেন।
বুধবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে সাবান-শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট ও টুথপেস্টের মতো পণ্যসামগ্রীর দাম কমানোর বিষয়ে দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন সংস্থাটির মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান। ওই সময় তিনি বলেন, তেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এবং নিয়ন্ত্রণ করেও। তবে প্রসাধনী পণ্যগুলোর দাম হিমালয়ের মতো আকাশের দিকে উঠেছে।
ডলার বলেন, কাঁচামাল বলেন, এগুলো কমলে আর কমাচ্ছেন না, আবার বাড়লে সেখান থেকে বাড়াচ্ছেন। কাঁচামালের দাম বাড়লে পণ্যমূল্য বাড়লেও কাঁচামালের দাম কমলে কেন পণ্যমূল্য কমে না- এমন প্রশ্নও ছুড়ে দেন তিনি। অধিদফতরের কার্যালয়ে এ মতবিনিময়ে ইউনিলিভার বাংলাদেশ, স্কয়ার টয়লোিট্রজ, কল্লোল গ্রুপ অব কোম্পানিজ, কোহিনুর ও এসিআই লিমিটেডের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, ভোক্তারা আপনাদের রঙিন বিজ্ঞাপন দেখতে চায় না। তারা কমমূল্যে পণ্য চান। ভোক্তা স্বার্থের বিষয়টি আগে বিবেচনায় নিতে হবে। ক্রেতারা যদি দামের কারণে পণ্য ব্যবহার করতে সক্ষম না হউন তাহলে বিজ্ঞাপন প্রচার করে লাভ কি? আপনাদের আগে এ বিষয়গুলোতে নজর দেয়া প্রয়োজন। লিমিট মুনাফা করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, অতিরিক্ত মুনাফা করার সুযোগ নেই।
গত কয়েক মাসে সাবান-শ্যাম্পুর দাম ইচ্ছেমতো বাড়ানো হয়েছে। এভাবে দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপনের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। আর এর দায়ভার পড়ছে ভোক্তার ওপর। সুগন্ধী পোলার চাল বাংলাদেশে উৎপাদন হয়-অথচ কোম্পানিগুলো নিজেদের ব্র্যান্ড বানিয়ে রঙিন বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। এতে তাদের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, যার দায় পড়ছে ভোক্তার কাঁধে।
একইভাবে টয়লেট্রিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও বিজ্ঞাপনের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। এর ফলে দাম বাড়ছে। এসব বিষয়ে আগামীতে সরকারী নজরদারি বাড়ানো দরকার। এএইচএম সফিকুজ্জামান আক্ষেপ করে আরও বলেন, আপনারা পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ান, কমার সময় সেভাবে কমে না। এক জায়গায় লক হয়ে থাকে। এরপর হিমালয়ের মতো ওপরের দিকে উঠতেই থাকে।’ ভোক্তা কনজুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সংগঠক কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, ডিটারজেন্টের কাঁচামাল সালফিউরিক এসিড ও সোডিয়াম সালফেট নামে এনে সোডিয়াম ক্লোরাইড বলে সাদা লবণ হিসেবে মার্কেটিং করছে।
যে প্রোডাক্ট বেশি বিক্রি হয় কোম্পানিগুলো সেগুলোর দামই বাড়াচ্ছে। অথচ যেটার দাম বাড়ালে অন্য কোম্পানির দখলে তা চলে যেতে পারে, তার দাম কিন্তু আপনারা বাড়ান না। কিন্তু যেই পণ্যের মনোপলি তৈরি করে ফেলেছেন, সেটার দাম বাড়াচ্ছেন। বৈঠকে ইউনিলিভারের চীফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) জাহিদ মালিতা জানান, গ্লোবাল মার্কেটে মূল্যস্ফীতি হলে আমাদের ওপরও এটার প্রভাব পড়ে।
এ হিসেবে সব মিলিয়ে একটা পণ্যের দাম বেড়েছে ৯৬ শতাংশ। তিনি বলেন, ভোক্তা ইন্টারেস্ট (স্বার্থ) নিশ্চিত করলে ব্যবসা ভাল হবে। ইউনিলিভার আধা সরকারী কোম্পানি। সরকারের শেয়ার আছে ইউনিলিভারে। গত দুই বছরে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে এটা কি কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়েছে নাকি কস্ট বেইজ তা আপনারা যাচাই করে দেখবেন।
কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, জ্বালানি তেল এবং ডলার-দিরহামের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণ দেখিয়ে কোম্পানিগুলো সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, পারফিউম, বিভিন্ন ক্রিম ও টয়লেট্রিজ পণ্যের দাম প্রায় ৫০-১০০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, তাদের উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামালের ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এগুলোর দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি ডলার ও দিরহামের বিপরীতে টাকার দরপতনেও উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। আগের তুলনায় খরচ ৯৬ শতাংশ বেড়েছে দাবি করে প্রতিনিধিরা বলেন, তারা ভোক্তাদের স্বার্থের কথা ভেবে দাম কম বাড়িয়েছেন। এ কারণে তাদের লোকসান হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত এক বছরে মান ও প্রকারভেদে সাবান-শ্যাম্পুর দাম বেড়েছে ৫০-১০০ শতাংশ। ৮০ টাকা থেকে ডাভ সাবান এখন ১৫০ টাকা। ২০০ গ্রাম ওজনের ইমপেরিয়াল লেদার সাবান (থাইল্যান্ড) ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৯৫ টাকা। মানভেদে ৮০ টাকার গায়ে মাখা সাবান বেড়ে হয়েছে ১৩০-১৫০ টাকা। এছাড়া বডি স্প্রের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০-৭০ শতাংশ। ৪০০ মিলির যে নিভিয়া লোশনের দাম ছিল ৬২০ টাকা, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫০ টাকা।
৩২০ মিলির সানসিল্ক শ্যাম্পুর দাম বেড়েছে ১০০ টাকা। আগে যেটা বিক্রি হতো ৩৬০ টাকায়, তা এখন বেড়ে হয়েছে ৪৬০ টাকা। ২০০ মিলির জিলেট শেভিং জেল ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩২৫ টাকা। দাম বেড়েছে গুঁড়া সাবানেরও। এক কেজি ওজনের গুঁড়া সাবান এখন ১৫০ টাকা, যা আগে ছিল ৮০ টাকা। মানভেদে ২০০ গ্রাম ওজনের সব ব্র্যান্ডের টুথপেস্টে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। যেমন- ২০০ গ্রাম ওজনের কোলগেট টুথপেস্টের দাম ১৩০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা।
বৈঠকে স্কয়ার টয়লেট্রিজের হেড অব অপারেশনস মালিক সায়িদ বলেন, সবকিছুই দাম হুট করে বেড়ে যায়নি। দাম বেড়েছে ধীরে ধীরে। ৫০, ৬০, ৭০ থেকে ১০০ পর্যন্ত এভাবে দাম বেড়েছে। ভোক্তারা বিরক্ত হলে তারা অন্য ক্যাটাগরিতে চলে যাবে। রিস্ক নিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে। আর এতে বিক্রির পরিমাণ কমছে। তিনি বলেন, যদি দাম (কাঁচামালের) কমার চিত্র দেখি, তাহলে আমরা দাম কমাব।
এদিকে মানুষকে বাজারে গিয়ে যেমন চাল, ডাল, তেল, চিনি, দুধ কিনতে ব্যাপক বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে, তেমনি সাবান ও সমজাতীয় পণ্য কিনতে হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি দামে। খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে সুগন্ধী সাবানের বাজারের আকার বার্ষিক প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার। এ বাজারের অর্ধেকের বেশি ইউনিলিভারের হাতে। সাবানের বাজারে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে স্কয়ার টয়লেট্রিজ।