কাল জাতীয় সম্মেলন ॥ আসছে এক ঝাঁক নতুন মুখ

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল মানেই নতুন নতুন চমক। এবারের সম্মেলনেও আগামী তিন বছরের জন্য দল পরিচালনায় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনে বেশ কিছু চমক আনবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসছেন একঝাঁক নতুন মুখ। বাদ পড়তে পারেন অনেকেই। কে বাদ পড়ছেন, কাদের কপাল খুলছে, আগামী তিন বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে ওবায়দুল কাদের নাকি অন্য কাউকে বেছে নিয়ে নেবেন- এ নিয়ে আলোচনা-গুঞ্জনের যেন শেষ নেই।
আগামীকাল শুক্রবার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক জাতীয় কাউন্সিল। কাউন্সিলকে ঘিরে এখন মুখরিত আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি ও বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের কার্যালয়। সর্বত্রই একই আলোচনা- কে হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক? পুনরাবৃত্তি নাকি পরিবর্তন? আগামী শনিবারই নির্ধারিত হবে আওয়ামী লীগের বর্তমানে পদে থাকা ও পদপ্রত্যাশীদের ভাগ্য। ওইদিন সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে নির্বাচন করা হবে আগামী তিন বছরের জন্য নতুন নেতৃত্ব। ব্যালট পেপার, স্বচ্ছ ব্যালট ও নির্বাচন কমিশন সব প্রস্তুত। টানা ৯ম বারের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন ৩৮ বছর ধরে দলটির নেতৃত্বদানকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি দলটির কোটি নেতাকর্মী-সমর্থকরা নিশ্চিত। তবে সবারই দৃষ্টি সাধারণ সম্পাদক পদটির দিকে। কে হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক? ওবায়দুল কাদেরই বহাল থাকছেন, নাকি চমক দেয়ার মতো অন্য কেউ- এ নিয়ে দলটিতে গুঞ্জন-আলোচনা এখন চরমে। তবে শেষ পর্যন্ত কার ভাগ্য খুলবে- তা শনিবারই নির্ধারিত হবে। তবে এবারের নতুন কমিটিতে তারুণ্যের চমক থাকছে বলে জানা গেছে।
এদিকে কাউন্সিল অধিবেশনকে ঘিরে এখন ঘুম হারাম অবস্থা বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতাদের। অনেকেই ভুগছেন পদ হারানোর আতঙ্কে। আবার অনেকে রয়েছেন পদোন্নতির আশায়। দলের সভাপতিম-লীতে কিছু নতুন মুখ আসতে পারে এবং সম্পাদকমন্ডলী ও সদস্যপদে বড় ধরনের রদবদলের সম্ভাবনা আছে বলে দলের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সূত্র থেকে আভাস পাওয়া গেছে। তবে দলটির সূত্রগুলো বলছে, নবীন ও প্রবীণের সম্মিলনে আওয়ামী লীগে নতুন নেতৃত্ব আসবে। এতে প্রবীণদের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সংগঠনকে গতিশীল করতে কমিটিতে তারুণ্যের নতুন রক্ত সঞ্চালন করা হবে।
আগামীকাল ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হবে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় কাউন্সিল। আগামীকাল বিকেল ৩টায় দু’দিনব্যাপী এ সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন শনিবার অনুষ্ঠিত হবে দলটির দ্বিতীয় অধিবেশন। এ অধিবেশনেই আগামী তিন বছরের জন্য নতুন কমিটি ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের সাড়ে সাত হাজার কাউন্সিলর ২১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মাঠে দ্বিতীয় অধিবেশনে নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য বসবেন।
ইতোমধ্যে সম্মেলনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে আওয়ামী লীগ। সম্মেলনে সাড়ে সাত হাজার কাউন্সিলর ছাড়াও সমসংখ্যক ডেলিগেট সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। প্রায় ১৫ হাজার অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে উদ্বোধনী অধিবেশনে। জামায়াতে ইসলামীসহ স্বাধীনতাবিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দল ছাড়া বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, গণফোরাম, ১৪ দলসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রায় সকল দলকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে। এর মধ্যে কূটনীতিকরাও রয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আওয়ামী লীগের সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই কম। নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অধিকাংশ নেতারই ধারণা ওবায়দুল কাদেরই দ্বিতীয় মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক হতে যাচ্ছেন। তবে দলের সভাপতিমন্ডলী ও সম্পাদকমন্ডলী নবীন ও প্রবীণের সমন্বয়ে ঢেলে সাজানো হতে পারে। গত তিন-চার মেয়াদে একই পদে থাকা অনেক নেতারই পদ পরিবর্তন হতে পারে। সদস্যপদসহ সম্পাদকমন্ডলীতে এবার দেখা যেতে পারে একঝাঁক নতুন মুখ। সেক্ষেত্রে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদেরকে প্রাধান্য দেয়া হতে পারে। এছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী সদস্য সংখ্যাও এবার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
তবে দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক নেতা বেশ স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন, সম্মেলনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠিক কে কে আসছেন, কাদের পতন হবে বা কাদের পদোন্নতি ও নতুন মুখের আগমন ঘটবে সে বিষয়ে একমাত্র দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কারও জানা নেই। একমাত্র দলীয় প্রধানই জানেন কাকে কাকে নিয়ে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলবেন। গণমাধ্যমে অনেকের নাম প্রকাশ হলেও আওয়ামী লীগের কোন পদেই ঘোষণা দিয়ে কারও প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই, অতীতেও কখনো হয়নি। তবে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবে, তবে প্রধানমন্ত্রী যাঁকে যে পদ দেবেন, সব কাউন্সিলরই তা একবাক্য মেনে নেবেন।
দলীয় সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগের প্রায় সব সাধারণ সম্পাদকই দুইবার করে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হৃদরোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি আবারও এ পদে থাকবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরের শারীরিক অবস্থা এখন অনেক ভাল। ফলে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে এ পদে আরও কয়েকজনের নাম আলোচনা চলছে দলটির বিভিন্ন মহলে। দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর নামও বেশ উচ্চারিত হচ্ছে সাধারণ সম্পাদকের প্রতিযোগিতায়।
তবে কাউন্সিলরদের মধ্যে গতবারের মতো এবারও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা এবং বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আনার দাবি রয়েছে। ইতোমধ্যে সজীব ওয়াজেদ জয়কে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর করা হয়েছে তাঁর পিতৃভূমি পীরগঞ্জ থেকে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আনার দাবি উঠতে পারে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশনে।
রেওয়াজ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণের আগেই বর্তমান কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তিনি সভাপতির আসন ছেড়ে কাউন্সিলরদের জন্য নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসবেন। এরপর নির্বাচন কমিশন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করবেন। প্রথমে দলটির দু’জন প্রবীণ নেতা সভাপতি পদে নাম প্রস্তাব ও সমর্থন করবেন। একাধিক প্রার্থী না থাকলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। একই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন করা হবে সাধারণ সম্পাদক। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে একাধিক কোনো প্রার্থী না থাকলে প্রস্তাবিত দু’জনকেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত ঘোষণা করবেন নির্বাচন কমিশন।
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচনের পর নবনির্বাচিত নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মূল মঞ্চে উঠে পরবর্তী কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করবেন। এরপর বাকি পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের দায়িত্ব কাউন্সিলররা সভানেত্রী শেখ হাসিনার ওপরই অর্পণ করবেন। তাই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গঠনের চাবিকাঠি দলের প্রধানের হাতেই থাকছে। অনুমাননির্ভর নানাজনের নাম আসলেও নীতিনির্ধারকরা বলছেন, প্রবীণ-নবীনের সংমিশ্রণে নতুন নেতৃত্ব গঠিত হবে। গতবারের কেন্দ্রীয় কমিটি ও মন্ত্রিসভার মতো এবারও বড় চমক আনতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এবার দ্বিতীয় অধিবেশনে অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতার নামই ঘোষণা করতে পারেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা।
আসছে একঝাঁক তরুণ মুখ : বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে দলকে সারাদেশে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে এবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বেশ কয়েকজন তরুণ নেতাকে যুক্ত করা হতে পারে। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবেন। তরুণ নেতাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যোগ দিতে প্রতিযোগিতারও কমতি নেই। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছেন- টঙ্গীর সাবেক মেয়র আজমত উল্লাহ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী, শফি আহমেদ, বাহাদুর বেপারী, এ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, শাহজাদা মহিউদ্দিন, তারেক শামস হিমু, মাহমুদ হাসান রিপনসহ আরও বেশ কজন সাবেক ছাত্রনেতা।
সভাপতি ও সম্পাদকমন্ডলীতেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা : এবারের সম্মেলনেও বেশ কিছু নক্ষত্রের পতন ঘটতে পারে। আবার অনেকেরই পদোন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। সভাপতিমন্ডলী থেকে ৪/৫ জনের বাদ পড়ার সম্ভাবনা বেশি। সেখানে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র কয়েকজন নেতাকে পদোন্নতি দিয়ে সভাপতিমন্ডলীর সদস্য করার বিষয়ে গুঞ্জন রয়েছে। আটটি সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যেও দু’তিন জন বাদ পড়তে পারেন, দু’জন পেতে পারেন পদোন্নতি। চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে অধিকাংশেরই পদোন্নতির সম্ভাবনা প্রবল। মন্ত্রিসভায় রয়েছেন এমন কয়েকজন নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে কার্যনির্বাহী সদস্য করা হতে পারে।
নারী নেতৃত্ব বাড়ছে : বর্তমান কমিটিতে সভাপতিসহ বিভিন্ন পদে ১৫ জন নারী রয়েছেন। নতুন কমিটিতে এ সংখ্যা বাড়িয়ে ২০-এ উন্নীত করা হতে পারে। আইন অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সব স্তরের কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ নারীকে রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসাবে এবারের কমিটিতেই আওয়ামী লীগের নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়তে পারে।
দলের একাধিক সূত্র জানায়, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নারীকে এবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আনা হতে পারে। জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও সংসদ সদস্য সৈয়দা জাকিয়া নূর, সাবেক সংসদ সদস্য ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি, সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী আমেনা কোহিনুরসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দু’একজন বিশিষ্ট নেত্রীকে দেখা যেতে পারে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে।