সড়কের দু’পাশে গাছ লাগানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

11
একনেক চেয়ারপার্সন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা অনুষ্ঠিত হয়।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বৃষ্টির পানি বা প্রচন্ড রোদে যাতে সড়ক নষ্ট না হয় সেজন্য সড়কের দু’পাশে গাছ লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গাছ ছায়া দিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রাখে। সড়ক ও পরিবেশের উপকার করে। তাই সড়কের দু’ধারে রেইনট্রি জাতীয় গাছ লাগাতে হবে। মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সম্মেলন কক্ষে পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন।
একনেক বৈঠকে সড়ক উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সম্প্রসারণ নিয়ে ছয়টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলোতে মোট খরচ হবে ৭ হাজার ৩১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিল থেকে ২ হাজার ৭৭৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৪ হাজার ২১২ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে ৩২১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা খরচ হবে। একনেক সভার সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনা। সভা শেষে সাংবাদিকদের বিস্তারিত তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সংবাদ ব্রিফিংয়ের সময় আরও উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা সচিব নুরুল আমিন, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
সকল আন্তঃজেলা সড়কগুলো চার লেন করা হবে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, সরকারের এখন প্রধান দুটি লক্ষ্য সড়ক উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। সেই জন্য এই একনেকে ছয়টি প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটিই হচ্ছে সড়কের। সরকারের লক্ষ্যই হচ্ছে সড়ক সংস্কার, বাঁক সোজা করা এবং পুরনো লক্কড় ঝক্কড় সেতু বাতিল করে নতুন সেতু নির্মাণ করা। এছাড়া আন্তঃজেলা সড়কগুলো চার লেন করা হবে। আমরা সড়কের জাল বিস্তার করেছি। এখল সুফল পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী চান আরও গতি। এজন্য যা যা করার সব করা হবে। এছাড়া সড়কের দু’পাশে গাছ লাগানোরও পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রী আরও বলেন, উন্নয়নের আরেক রাজা বিদ্যুৎ। তাই বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণে একটি বড় প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জন্য যত্রতত্র আবাসিক বাড়ি না করারও নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী। এক্ষেত্রে ভূমির অপচয় কমাতে সমন্বিতভাবে বহুতল বিশিষ্ট আবাসিক ভবন তৈরির কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১০ বছরে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে যেসব অনুশাসন দিয়েছেন সেসব নিয়ে প্রকশিত একটি বই প্রধানমন্ত্রীর হাতে এ বই তুলে দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ২০০৯-১৯ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে যেসব অনুশাসন দিয়েছেন সেসব অনুশাসন-সংবলিত একটি প্রকাশনা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া অনুশাসনের কত শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, তার অনুশাসন নিয়ে যে বই প্রকাশ করা হয়েছে এতেই তিনি খুশি হয়েছেন। তাছাড়া এগুলোর বাস্তবায়ন তো যখনই তিনি অনুশাসন দেন তখনি শুরু হয়ে যায়। এটা শতাংশ হিসেবে বলা যাবে না যে এখন পর্যন্ত কত শতাংশ অনুশাসন বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে এসব অনুশাসন অবশ্য পালনীয়। প্রকল্প পরিচালকদের এগুলো মেনেই কাজ করতে বলা হবে। সেই সঙ্গে পরিকল্পনা কমিশন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রক্রিয়াকরণ করার সময় এসব অনুশাসন মিলিয়ে দেখবে।
ফুটপাথ রক্ষা সংক্রান্ত এক নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, বড় বড় প্রকল্প যেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়, সেগুলোতে পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ রাখছি। এখানেও পুনর্বাসনের নির্দেশ আছে। তবে এর বর্তমান পরিস্থিতি এই মুহূর্তে আমি বলতে পারছি না। এরপরও বলছি, অনেক মানুষ ভিটেমাটি হারাবে, মানবিক কষ্ট হবে। এগুলোকে স্বীকার করেই আমাদের এগোতে হবে। মন্ত্রী বলেন, গাছ কাটলে যেমন পরিবেশবাদীরা বাধা দেন, আমি সেলুট দিই। কিন্তু আমরা গাছ কাটতে বাধ্য হই। তেমনি ফুটপাথের জন্য ¯েœহ আমারও আছে। ফুটপাথ হলো আপনার আমার ঠিকানা, কিন্তু কী করব। দেশের উন্নয়নের জন্য অনেক সময় এগুলো আমাদের স্বীকার করতে হয়।
এদিন বৈঠকে ৫ হাজার ৯৪৯ কোটি ৯৫ লাখ ২৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘ঢাকা এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় গ্রিড সঞ্চালন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ’ নামে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। বিদ্যমান সঞ্চালন অবকাঠামো ব্যবস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালী করার মাধ্যমে ঢাকার ডেসকো এলাকা এবং দেশের পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে এটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বিদ্যুতের এই প্রকল্পে সরকার দেবে ১ হাজার ৪১৫ কোটি ৯৫ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। প্রকল্প ঋণ হিসেবে সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) যৌথভাবে ৪ হাজার ২১২ কোটি ৩০ লাখ ৪১ হাজার টাকা। সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ৩২১ কোটি ৬৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। প্রকল্পটি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি) বাস্তবায়ন করবে।
এ প্রকল্পের আওতায় ২২ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, ১৪৪ কিলোমিটার ২৩০ লাইন, ২৪২ কিলোমিটার ১৩২ কেভি লাইন, ২টি ৪০০ কেভি উপকেন্দ্র, ৩টি ২৩০ কেভি উপকেন্দ্র, ১০টি ১৩২ কেভি উপকেন্দ্র নির্মাণ এবং ২০টি ১৩২ কেভি সম্প্রসারণ করা হবে। চলতি বছর থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সবার কাছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ করার জন্য পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বিদ্যুত উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুত সঞ্চালন খাতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচী নিয়েছে। বাংলাদেশের সামগ্রিক গ্রিড ব্যবস্থাকে ৯টি জোনে বিভক্ত করা হয়েছে। জোনগুলো হলোÑ ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল।
মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকায় ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুত বিতরণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ডেসকো একটি স্বতন্ত্র পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে ডেসকো এলাকার ভবিষ্যত বিদ্যুত চাহিদার একটি সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। এই সমীক্ষা মোতাবেক ২০৩০ সালে ঢাকার ডেসকো এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার মেগাওয়াট হবে। এ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে প্রকল্পের আওতায় ডেসকো এলাকায় দুটি ৪০০ কেভি এবং একটি ২৩০ কেভি জিআইএস উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। বিদ্যুত বিভাগ সূত্রে আরও জানা গেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকার শিল্প-বাণিজ্যের আরও উন্নয়ন আশা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) বরিশাল এলাকায় তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে প্রকল্পের আওতাধীন দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপকহারে বাড়বে। অন্যদিকে খুলনা শহর একটি শিল্প এলাকা। এ এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেজা খুলনা এলাকায় কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। খুলনা ও বরিশাল এলাকার ভবিষ্যত বিদ্যুত চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় দুটি ২৩০ কেভি, ৮টি ১৩২ কেভি জিআইএস উপকেন্দ্র এবং সংশ্লিষ্ট ২৩০ কেভি এবং ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হবে। তাছাড়া রংপুর বিভাগের আওতাধীন হাতিবান্ধা উপজেলায় লালমনিরহাট গ্রিড উপকেন্দ্র থেকে ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩৩ কেভি লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়। ফলে এ এলাকায় সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুত সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হলে হাতিবান্ধা এলাকায় শিল্পায়নের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এ এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যে হাতিবান্ধা ও ডোমার এলাকায় একটি করে মোট দুটি ১৩২ কেভি জিআইএস উপকেন্দ্র এবং সংশ্লিষ্ট ২৩০ কেভি ও ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা প্রহণ করেছে পিজিবিসি।
মঙ্গলবার অনুমোদন দেয়া অন্যান্য প্রকল্পগুলো হচ্ছে, পালবাড়ী-দড়াটানা-মনিহার-মুড়ালী জাতীয় মহাসড়কের মনিহার থেকে মুড়ালী পর্যন্ত ৪ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের খরচ ১৩১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। বগুড়া-সারিয়াকান্দি জেলা মহাসড়ক উন্নয়ন এবং বাঙ্গালী নদীর উপর আড়িয়ারঘাট সেতু নির্মাণ প্রকল্পের খরচ হবে ২৪০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। মাগুরা-নড়াইল আঞ্চলিক মহাসড়কের বাঁক সরলীকরণসহ যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৭২৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ফেনী আলোকদিয়া-ভালুকিয়া-লস্করহাট-ছাগলনাইয়া জেলা মহাসড়কটি যথাযথ মান ও প্রশস্ত উন্নীতকরণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৫৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। নাটোর রোড থেকে রাজশাহী বাইপাস পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ২০৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
একনেক বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন- অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, কৃষিমন্ত্রী মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হূমায়ুন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।