হলি আর্টিজান মামলার রায় আজ, কঠোর নিরাপত্তা

11

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দুনিয়া কাঁপানো ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গি হামলা মামলার রায় ঘিরে সারাদেশে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকছে ঢাকার আদালত। এছাড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিরও। যে কোন ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত থাকছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল ইউনিট। রায় পর্যবেক্ষণে আদালতে যাবেন দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকরা। রায় ঘিরে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে গোপন বৈঠকের সময় নওগাঁ থেকে ছাত্র শিবিরের ৯ নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে।
র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বাহিনীটির সদর দফতরে সাংবাদিকদের বলেন, রায় ঘিরে র‌্যাব সতর্ক আছে। সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। জঙ্গিরা যেন কোন ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ না করতে পারে, সেজন্য র‌্যাব সতর্ক আছে। দৃষ্টান্তমূলক রায় হবে বলে আশা করছি।
এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার আদালত পাড়া পরিদর্শন করেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মীর রেজাউল আলম ও কৃষ্ণ পদ রায়। পরিদর্শন শেষে তারা আদালত পাড়ার বিশেষ নিরাপত্তায় লালবাগ ডিভিশন ও ডিসি প্রসিকিউশনকে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেন।
ডিসি প্রসিকিউশন জাফর হোসেন জানান, হলি আর্টিজান মামলার রায় উপলক্ষে সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। কারাগার থেকে আদালতে আসামিদের হাজিরার ক্ষেত্রে বিশেষ নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হবে।
গুলশান হামলার মামলার রায়ের সময় আদালতে থাকবেন দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকরা। হামলায় যেসব দেশের নাগরিকরা নিহত হয়েছিলেন, ওইসব দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারা রায় শুনতে যাবেন বলে জানা গেছে।
মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির সাংবাদিকদের জানান, জাপানসহ কয়েকটি দেশের দূতাবাসের প্রতিনিধিরা রায় শুনতে আদালতে উপস্থিত থাকবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের অর্থায়নে পরিচালিত ন্যাশনাল সেন্টার ফর স্টেট কোর্টের প্রতিনিধি হিসেবে আবু ওবায়দুর রহমান টগর রায় পর্যবেক্ষণে এজলাসে থাকবেন বলে জানা গেছে।
ঢাকা মহানগর অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপ-কমিশনার জাফর হোসেন জানান, যে আদালতে রায় হবে, সেখানে দিনের প্রথমভাগে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক বসেন। দ্বিতীয়ভাগে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক বসেন। দুই বিচারকই সিদ্ধান্ত নেবেন, বুধবার কোন আদালত প্রথমে বসবে।
রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী গোলাম ছারোয়ার খান জাকির জানান, আদালতের কার্যক্রম দুপুর ১২টার দিকে শুরু হবে। বিচারক মোঃ মজিবুর রহমান আসন নেয়ার পর ঘোষণা করা হবে রায়। এজলাসের আয়তন ছোট বলে সেখানে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হবে। মামলায় সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ছাড়া কেউ যাতে এজলাস কক্ষে না ঢোকেন, সে বিষয়ে পুলিশ তৎপর থাকবে। তবে আদালত প্রতিবেদক বা কোর্ট রিপোর্টাররা এজলাসে যাতে ঢুকতে পারেন, সেই সুযোগ থাকছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় গুলশান লেক লাগোয়া হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গিরা হামলা চালায়। হামলায় প্রথম দফায় নিহত হন বনানী মডেল থানার ওসি সালাহ উদ্দিন আহমেদ খান ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম। এরপর জঙ্গিরা রেস্তরাঁর সবাইকে ভারি অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। তখন পবিত্র মাহে রমজানের রোযা চলছিল। জিম্মির পর জঙ্গিরা ইতালির ৯ জন, জাপানের ৭ জন, ১ জন ভারতীয় ও ৩ বাংলাদেশীকে গুলি ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। হত্যার পর তাদের বিভৎস ছবি তুলে রাখে।
নৃশংস ওই জঙ্গি হামলার পর দায় স্বীকার করে আইএসের নামে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। সারাবিশ্বে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটেছে বলে নানাভাবে প্রপাগা-া চালানো হয়। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশে আইএস তৎপরতা রয়েছে দাবি করে আসছিল। শেষ পর্যন্ত তদন্তে বেরিয়ে আসে বিগত বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে আলোচনায় আসা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবিরই নতুন একটি অংশ যেটি নব্য জেএমবি হিসেবে পরিচিত তারাই হামলাটি চালিয়েছে। শেষ অবধি বাংলাদেশে যে আইএস নেই, তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
হামলার পরদিন ভোরে সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের অভিযানে হামলাকারী জঙ্গি নিবরাজ ইসলাম, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল নিহত হয়। অভিযানে রেস্তরাঁর পাঁচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নিহত হন। কমান্ডোরা জীবিত অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে তিন বিদেশীসহ ১৩ জিম্মিকে উদ্ধার করেন। সবমিলিয়ে জিম্মি দশা থেকে ৩৩ জন জীবিত উদ্ধার হয়।
পরবর্তীতে হামলার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে তামিম আহমেদ চৌধুরী, সারোয়ার জাহান, মেজর (অব) জাহিদুল ইসলাম, তানভীর কাদেরী, নুরুল ইসলাম মারজান, আবু রায়হান তারেক, আব্দুল্লাহ মোতালেব, ফরিদুল ইসলাম আকাশ, বাশারুজ্জামান চকলেট ও ছোট মিজানসহ অনেকেই পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে ১৩ জন নিহত হয়।
পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে আসে হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও বিস্কোরক সরবরাহ করেছিল পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড়ে জেএমবির বোমা তৈরির কারখানায় বিস্ফোরণে জড়িত জেএমবির শীর্ষ নেতা হাতকাঁটা মাহফুজ। হলি আর্টিজানে হামলার পর সারাদেশে চালানো জঙ্গিবাদ বিরোধী অন্তত ৬০টি অভিযানে অন্তত এক শ’ জঙ্গির মৃত্যু হয়।
উল্লেখ্য, হলি আর্টিজান নামের ওই বাড়িটির মালিক সাদাত মেহেদীর পরিবার। সাদাত হোসেনের স্ত্রী সামিরা আহমেদ উত্তরাধিকার সূত্রে এই বাড়িটির মালিক। ১৯৭৯ সালে আবাসিক ভবন কাম ক্লিনিক গড়ে তোলার জন্য ডাঃ সুরাইয়া জাবিনকে বরাদ্দ দেয়া হয় বাড়িটি। ১৯৮২ সালে ওই প্লটের দক্ষিণ দিকে গড়ে ওঠে লেকভিউ ক্লিনিক। ডাঃ সুরাইয়ার মৃত্যুর পর প্লটের মালিক হন তারই দুই মেয়ে সামিরা আহমেদ ও সারা আহমেদ।
সামিরার স্বামী সাদাত মেহেদী আর তার বন্ধু নাসিমুল আলম পরাগসহ কয়েকজন মিলে ২০১৪ সালের জুনে বাড়িটিতে গড়ে তুলেন হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্তরাঁ। হামলার ছয় মাস পর গুলশান এভিনিউর র‌্যাংগস আর্কেডের দ্বিতীয় তলায় স্বল্প পরিসরে হলি আর্টিজান বেকারিটি নতুন করে চালু করা হয়। সেখানে পুরনো বেকারির পাঁচ কর্মচারীসহ মোট আটজন কাজ করতেন।
প্রসঙ্গত, জঙ্গি হামলার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গুলশান মডেল থানায় মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলা দায়েরের তিন বছর চার মাস পর বুধবার দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা মামলার রায় ঘোষিত হতে যাচ্ছে। মামলায় ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
ওই মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম সারোয়ার খান জাকির বলেন, রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায়ে ৮ আসামির মৃত্যুদণ্ড আশা করছি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, আদালতের কাছে ন্যায়বিচার পাব।
গত ১৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ২৭ নভেম্বর দিন ধার্য করেন।
মামলা দায়ের করার পর ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) পরিদর্শক হুমায়ুন কবির। একই বছর ২৬ নভেম্বর ৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
মামলার আসামিরা হচ্ছে, জঙ্গি জাহাঙ্গির আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র‌্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, হাদিসুর রহমান সাগর, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ।
এছাড়া বিভিন্ন অভিযানে ১৩ জন নিহত হওয়ায় মামলা থেকে তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। পরে মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়া হয়।