কাজিরবাজার ডেস্ক :
নতুন করে সারাদেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তালিকা তৈরিতে হাত দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তালিকা তৈরির পর অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে চালানো হবে সাঁড়াশি অভিযান। বর্তমানে রুটিন কাজ হিসেবে কিছু অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নিরাপদ জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি মালিকদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে কঠোর আইনী ব্যবস্থা। অভিযোগ উঠেছে, রাজধানীসহ সারাদেশ গড়ে উঠেছে প্রায় সাত হাজার অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। স্ব স্ব নীতিমালায় চলছে এ সব প্রতিষ্ঠান। রোগীদের কাছ থেকে নিজেদের মতো করে ফি আদায় করছে তারা। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে আদায় হয় একেক ধরনের ফি। চরম বিভ্রান্তিতে ভুগছেন রোগী ও তাদের অভিভাবকরা। এভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা। সরকারী নির্দেশ পাওয়ার পরও অধিকাংশ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্ধারিত ফি এর তালিকা টাঙানো হয়নি। সারাদেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর পূর্ণাঙ্গ চিত্র না থাকায় অভিযান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। নানা কৌশলে সুযোগ নিয়ে এসব ক্লিনিকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দিনের পর দিন রোগীদের ঠকিয়ে যাচ্ছে বলে জানান মহাপরিচালক।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, নিরাপদ জনস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে বদ্ধপরিকর বর্তমান সরকার। রাজধানীসহ সারাদেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তালিকা তৈরির কাজ এখনও চলছে। তালিকা তৈরির পাশাপাশি কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল বিভাগ এ অভিযান পরিচালনা করছে। অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জনসাধারণকেও সোচ্চার হতে হবে। এ সব অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার উচ্ছেদকরণে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি বলেন, অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা শত শত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার দেশের স্বাস্থ্যসেবার জন্য চরম হুমকি। ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজ সম্পাদনের অভিযোগও পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, দেশের ভাল ভাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক উঠিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। তবে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোরও উচিত চিকিৎসাসেবার দেয়ার সময় মানবিক দিক বিবেচনা করা। রোগীদের কাছে থেকে চড়া ফি আদায় করা ঠিক হবে না। দেশের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে খারাপের সংখ্যাই বেশি বলে তিনি মনে করেন। নির্ধারিত ফি আদায়ের ব্যাপারে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ফি নির্ধারণ করা উচিত। আর বিভিন্ন ক্লিনিকে সরকারী ডাক্তারের সঙ্গে রোগী পাচারের প্রথা বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পাড়া মহল্লা, অলি-গলি থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে শত শত অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এ সব প্রতিষ্ঠানে অবাধে চলছে রোগী মারার পাশাপাশি গলা কাটা ফি আদায়ের রমরমা ব্যবসা। সরকারী হাসপাতালগুলোর অনেক নামী-দামী চিকিৎসক পর্যন্ত ওইসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে আগের তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। সামান্য অসুখ-বিসুখেও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। শুধু তাই নয়, কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষাগুলো করতে হবে সে নির্দেশনাও দিচ্ছেন ডাক্তাররা। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দেশিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা না করালে রোগীদের ভর্ৎসনার শিকার পর্যন্ত হতে হয়। রোগীদের অভিযোগ, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের সঙ্গে চিকিৎসকদের লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে। ফলে চিকিৎসকরা এখন সামান্য জ্বর, ঠা-া, কাশির জন্যও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা লিখে দিচ্ছেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের শতকরা ৩৫ থেকে ৫০ ভাগ কমিশন দিয়ে থাকে। ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর চিকিৎসাসেবা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মান ও ফি নিয়মিত মনিটর করার মতো কোন জনবল নেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের। বর্তমান জনবল দিযে রাজধানীর প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো মনিটর করা সম্ভব হচ্ছে না। অপারেশন, ব্যবস্থাপনা কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের মালিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঠিক মূল্য নির্ধারণ করা স্বাধীনতার দীর্ঘ বছর পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এরশাদ সরকারের আমলে প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসাসেবা, অপারেশন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ নির্ধারণ করে অর্ডিন্যান্স জারি করলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। পরে তা বাতিল করা হয় বলে অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজির জন্য ৩৭ ধরনের, মাইক্রোবায়োলজি এন্ড ইমিউনোলজির জন্য ৪১, বায়োকেমিস্ট্রি ৪২, হিস্ট্রোপ্যাথলজি ৩, ড্রাগ এবিউজ ৮, থেরাপিউটিক ড্রাগ৫ ও ভাইরোলজির ২৩ ধরনের গ্রহণযোগ্য ফি প্রস্তাব করা হয়। ক্লিনিক্যাল প্যাথলজির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৮০ ও সর্বোচ্চ ৬শ’ টাকা, মাইক্রোবায়োলজি এ্যান্ড ইমিউনোলজিতে সর্বনিম্ন ১৫০ ও সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩শ’ টাকা, বায়োকেমিস্ট্রিতে সর্বনিম্ন ১২০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৮শ’ টাকা, হিস্ট্রোপ্যাথলজিতে সর্বনিম্ন ৫শ’ ও সর্বোচ্চ ১ হাজার ২শ’ টাকা, ড্রাগ এবিউজে সব ধরনের পরীক্ষা সাড়ে ৫শ’ টাকা, থেরাপিউটিক ড্রাগের ক্ষেত্রে ৫শ’ টাকা ও ভাইরোলজির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২শ’ ও সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়। অথচ এসবের কোন কিছুই পালিত হয় না ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে। শুধু তাই নয়, লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেই কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছেন অনেক ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিকের মালিক।