কাজিরবাজার ডেস্ক :
সুপরিকল্পিতভাবে পেঁয়াজের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে আকাশচুম্বী দাম বাড়িয়ে হাজার কোটি হাতিয়ে নেয়ার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে মাঠে নেমেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রাথমিক প্রতিবেদনে এ সঙ্কটকে কৃত্রিম উল্লেখ করায় শুল্ক গোয়েন্দারা নিজস্ব কৌশলে তদন্ত শুরু করেছে। এরই মধ্যে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটকে সন্দেহের আওতায় এনে তাদের তলব করা হয়। সোমবার এ সব অভিযোগ খন্ডন করে নিজস্ব অবস্থান তুলে ধরতে শুল্ক গোয়েন্দা হাজির হন দেশের শীর্ষ ১৩টি পেঁয়াজ আমদানিকারক। পেঁয়াজ সঙ্কট নিয়ে মিডিয়ায় প্রকাশিত অভিযোগগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হবে বলে জানিয়ে শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম বলেন, মাঠ পর্যায়ে প্রাথমিক খোঁজখবর নিতেই কাজ শুরু হয়েছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায় জরুরী তলবের মুখেই কাকরাইলের শুল্ক গোয়েন্দা অফিসে হাজির এসব হন আমদানিকারক। এর আগে বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গোয়েন্দা অধিদফতর থেকে তাদের ডেকে পাঠানো হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল তারা হাজির হন এবং আজও কয়েকটি আমদানিকারক শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে হাজির হবেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে পেঁয়াজের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরির। মূলত আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানতে ৪৭ আমদানিকারককে শুল্ক গোয়েন্দা অফিসে পৃথক পৃথক চিঠি পাঠিয়ে তলব করা হয়। এরই অংশ হিসেবে সোমবার কাকরাইলের শুল্ক গোয়েন্দা অফিসে এসব আমদানিকারক তাদের বক্তব্য তুলে ও ব্যাখ্যা দেন। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সেগুনবাগিচায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে শুনানি চলে। এরপর আধা ঘণ্টার বিরতি দেয়া হয়। বিরতির পর আবার শুনানি শুরু হয়। বিরতির সময় আমদানিকারকদের পক্ষ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক আব্দুল আওয়াল গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, যাদের ডাকা হয়েছিল, তাদের মধ্যে আমাদের চারজনের শুনানি শেষ হয়েছে। আমদানিকারকদের কারসাজির জন্য পেঁয়াজের দাম লাগামহীন হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুনানি শেষে বিস্তারিত জানানো হবে। কতজনকে এভাবে তলব করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বলতে গেলে দেশের শীর্ষ আমদানিকারকদেরই ডেকে সবার মতামত নেয়া হবে।
শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়- প্রথমবারের শুনানিতে হাজির হওয়া ১০ আমদানিকারক হচ্ছেÑ রাজশাহীর এমএস ফুল মোহাম্মদ ট্রেডার্স, চাঁপাইনবাবগঞ্জের একতা শস্য ভান্ডার, এমএস সাজ্জাদ এন্টারপ্রাইজ, নূর এন্টারপ্রাইজ, এমএস আ এম এ্যাগ্রো, টিএম এন্টারপ্রাইজ ও বিএইচ ট্রেডিং এ্যান্ড কোম্পানি, সাতক্ষীরার এমএস দীপা এন্টারপ্রাইজ প্রোপার্টিজ, নওগাঁর জগদীশ চন্দ্র রায় এবং বগুড়ার এমএস সুমাইয়া এন্টারপ্রাইজ। আজ মঙ্গলবার আরও ৩৩ আমদানিকারক সেখানে হাজির হয়ে তাদের বক্তব্য প্রদান করবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম বলেন, পেঁয়াজ আমদানিকারকদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কাছে থাকা তথ্যানুযায়ী দাম বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ যাচাই করা হবে। এরপর দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য রাজস্ব বোর্ডকে জানানো হবে।
তবে কি ধরনের বক্তব্য তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে এ বিষয়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না বললেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদঘাটনের দাবি করে বলেন, আগে সবার বক্তব্য নেয়া হোক। আজ মঙ্গলবার আরও ৩৩টি আমদানিকারকের বক্তব্য নেয়া হবে। আমরা আপাতত তাদের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছি।
কি ধরনের তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন- আমরা মূলত জানতে চাচ্ছি দেশে বর্তমানে কি পরিমাণ পেঁয়াজ মজুত আছে, কেন হঠাৎ এ বছর ঘাটতি দেখা দিল, ঘাটতি মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তারা তাদের দৃষ্টিকোণ যা বলার তাই বলেছে যা আমরা খতিয়ে দেখব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তাদের কাছ থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। যারা আমদানি করেছেন, তারা আমদানির পরে কোথায় কোথায় বিক্রি করেছেন। কী মূল্যে বিক্রি করেছেন। এখন পর্যন্ত তাদের হাতে কত টন পেঁয়াজ মজুত আছে, সেটাই আমরা জানার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি পেঁয়াজের বাজার সহনশীল হয়ে যাবে। বিমানের কার্গোতে পেঁয়াজ আসছে, কিছু কিছু প্যাসেঞ্জার বিমানেও পেঁয়াজ আসছে। আমরা যেটা দেখছি, বাজারে এখনও যথেষ্ট পেঁয়াজ আছে। কোন ঘাটতি নেই। তবে মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে বা সহনশীলতার বাইরে চলে গেছে। অথচ গত আগস্ট থেকে ১৮ নবেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৬৮ হাজার টনের মতো পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে।
এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী দুদিন আগে বলেছিলেন, এই সময় প্রতি মাসে এক লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি হয়। তাহলে গত বছরের তুলনায় এ বছর পেঁয়াজ আমদানি ঘাটতি কত? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাজারে গেলে পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ওই অর্থে কোন ক্রাইসিস নেই। আমরা দেখার চেষ্টা করছি, কারা কারা পেঁয়াজ আমদানি করে এখনও বিক্রি করেননি। তারা বিক্রি করলে সঙ্কটটা কমে যাবে। সেই উদ্যোগটাই মূলত আমরা নিচ্ছি। আসলে বেশি দামে বিক্রি করছে কি না, কত দিন ধরে রেখেছে- এ জিনিসগুলো আমরা বের করার চেষ্টা করছি।
মজুতদারি ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে আমদানিকারকদের ডাকা হয়েছে- এ বিষয়ে সহিদুল ইসলামের বক্তব্য, বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ তো আসতেই পারে বা আসে। একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়ার অবকাশ থাকে না। আমরা চলমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলেছি, কিন্তু কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
শুল্ক গোয়েন্দার কাজ শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে কি না সেটা দেখা। কিন্তু আপনারা আমদানি পরবর্তী সময়ের কাজ করছেন এটা করতে পারেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনায় আমরা এ কাজ করছি। আমরা সব বিভাগ একসঙ্গে কাজ করছি। যাতে দ্রব্যমূল্যের দাম স্বাভাবিক হয়ে যায়।
এভাবে ডাকার ফলে আমদানিকারকদের মধ্যে পেঁয়াজ আমদানিতে ভীতির সঞ্চার হতে পারে কি নাÑ এর জবাবে তিনি বলেন, আমাদের জনবল কম। তাই তাদের ঢাকায় ডেকে এনেছি। তাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে আলোচনা করছি। আমদানিকারকদের মাঝে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
এদিকে শুল্ক গোয়েন্দার পাশাপাশি রাজস্ব বোর্ডের গোয়েন্দা শাখাও পেঁয়াজ সঙ্কট তৈরির সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে তদন্ত করে প্রাথমিক প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনের রাজধানী ঢাকার মৌলভীবাজার, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের কয়েকটি শীর্ষ আমদানিকারককে এ সঙ্কট সৃষ্টির নেপথ্য নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাদের গতিবিধির ওপর নজরদারি চলছে।
উল্লেখ্য, গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে হঠাৎ বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। মাত্র এক মাসের মধ্যেই চল্লিশ টাকার পেঁয়াজের দাম বাড়তে বাড়তে একশ’ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এরপর সেটা আরেক লাফে দুশো টাকা ছাড়িয়ে যায়। এ নিয়ে দেশজুড়ে চলে হৈ চৈ। পেঁয়াজের সঙ্কট কৃত্রিম বলে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করার পর সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। জরুরীভাবে পেঁয়াজের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করে স্থল নদী ও আকাশ পথে পেঁয়াজ আমদানির ওপর ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দেয়া হয়। গত মাসে মিয়ানমার, তুরস্ক ও মিসর থেকে কিছু পেঁয়াজ আনার পাশাপাশি পাকিস্তান থেকেও জরুরীভাবে কার্গো বিমানে পেঁয়াজের চালান আনা হয়। তাতেও বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা প্রকৃত কারণ নির্ণয়ে মাঠে নামে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজস্ব বোর্ড ও শুল্ক গোয়েন্দা নিজস্ব উদ্যোগে পেঁয়াজ সঙ্কটের প্রকৃত কারণ উদঘাটনে সক্রিয় হয়।