কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাজধানীর যানজট কমাতে এবং নগরের মানুষের চলাচল সহজ করতে মেট্রোরেল করে দিচ্ছে সরকার। তবে ভবিষ্যতে মেট্রোরেল প্রকল্পে রেলের পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারের সুবিধা রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেট্রোরেল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যেন হাতিরঝিলের কোন সৌন্দর্য নষ্ট না হয় এবং বেশিসংখ্যক মানুষ সুবিধা পায় এমন রুট নির্বাচন করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়ার কথাও জানিয়ে আবাসিক ভবনে আর গ্যাস সংযোগ না দেয়ার নির্দেশনাও দিয়েছেন।
মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক বৈঠকে মেট্রোরেলের আরও দুটি নতুন রুট অনুমোদন কালে এসব নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনা। বৈঠকে মেট্রোরেলের নতুন দুটি রুটসহ মোট ১০টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। এগুলো বাস্তবায়নে মোট খরচ ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিল থেকে ৩০ হাজার ৪৬৬ কোটি, বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৫১৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে ৬৯ হাজার ৪৩ কোটি টাকা খরচ করা হবে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা সচিব নুরুল আমিন, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য শামীমা নার্গিস।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, মেট্রোরেলের নতুন রুট ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট এর লাইন-১ ও লাইন-৫ এর অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে লাইন-১ এর আওতায় রুট ধরা হয়েছে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর স্টেশন এবং নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত। আর লাইন ৫ এর আওতায় রুট ধরা হয়েছে, হেমায়েতপুর-আমিনবাজার-গাবতলী-মিরপুর ১-মিরপুর-১০-কচুক্ষেত-বনানী-গুলশান ২ নতুন বাজার হয়ে ভাটারা পর্যন্ত। যানজট নিরসনে আনুমানিক ৯৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে (এমআরটি লাইন ১ ও ৫ বাস্তবায়ন করা হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এমআরটি লাইন-১ এবং এমআরটি লাইন-৫ প্রকল্প রাজধানীর যানজটকে অনেকাংশে সহজ করবে। এতে পরিবেশবান্ধব, আধুনিক ও নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে।
একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর একাধিক নির্দেশনা তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আমরা জনগণের জন্য মেট্রোরেল করে দিচ্ছি। ভবিষ্যতে এমআরটিতে যেন সড়ক সুবিধা থাকে, গাড়ি চলতে পারে সেটি বলেছেন। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হলো বেশিসংখ্যক জনগণ যেন এর সুবিধা পায় সে ধরনের রুট নির্বাচন করতে হবে। এছাড়াও আমরা যে হাতিরঝিল করেছি মেট্রোরেলের কারণে তার সৌন্দর্য যেন নষ্ট না হয় সেটিও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, মেট্রোরেলের বাস্তবায়নকারী সংস্থার এমডি এম, এন সিদ্দিকী একনেকে অবহিত করছেন যে, নির্দিষ্ট সময়ের আগে এবং যতটা সম্ভব অর্থ সাশ্রয় করে প্রকল্প দুটি সমাপ্ত করা হবে। এই মেট্রোরেল হবে ব্যয় সাশ্রয়ী, আরামদায়ক। ইলেকট্রনিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে ফলে নির্দিষ্ট সময় এমনকি সেকেন্ডের হিসাবও ঠিক থাকবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, এখন সরকারী অর্থে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও আগামীতে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডকে শেয়ার বাজারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া আগামীতে ধানম-িকে ধরে আশপাশের এলাকার জন্য মেট্রোরেল তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। মেট্রোরেলের ব্যয়ের প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, এখন বেশি জমি অধিগ্রহণ করায় নতুন মেট্রোরেলের ব্যয় বেশি হচ্ছে। এছাড়া মাটির নিচে ও এলিভেটেড দুই ধরনের হওয়ায় কারিগরি অনেক বিষয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। এম এ মান্নান আরও বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারী সব বাসভবনে নেট লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, এখন থেকে যেসব সরকারী বাড়ি তৈরি করা হবে তার সবগুলোতে মসকিউটো নেটিং থাকতে হবে। ডেঙ্গু ও অন্য সবকিছুর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এটি করতে হবে।
এছাড়াও বাড়ির নিচতলায় গাড়ি চালক, অফিস সহায়কদের জন্য মৌলিক সুযোগ-সুবিধা নামাজ পড়ার জায়গা ও বিশ্রামের জায়গা খাওয়া, গল্প করা, টয়লেটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সব সরকারী বাসভবনের নিচে এ ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়াও আবাসিক ভবনে গ্যাস সংযোগের বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, এখন থেকে আবাসিক ভবনে গ্যাস সংযোগ না দেয়ার নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ধীরে ধীরে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারে মানুষকে অভ্যস্ত হওয়ার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, যে কোন প্রকল্প সময়ের মধ্যেই সংশোধন করতে হবে। কিন্তু সময় শেষে নিয়ে আসা যাবে না।
মেট্রোরেল প্রকল্প বিষয়ে জানা গেছে, লাইন-১ এর আওতায় মোট ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ২১৫ কিলোমিটার পাতাল (আন্ডারগ্রাউন্ড) মেট্রোরেল এবং কুড়িল থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬৯ কিলোমিটার এলিভেটেড মেট্রোরেল হবে।
লাইন-৫ এর আওতায় ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে হেমায়েতপুর থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার এলিভেটেড মেট্রোরেল এবং আমিনবাজার থেকে ভাটারা পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার পাতাল (আন্ডারগ্রাউন্ড) মেট্রোরেল হবে।
এর আগে অনুমোদন পাওয়া এমআরটি লাইন-৬ রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল সিটি সেন্টার পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার এলিভেটেড মেট্রোরেল নির্মাণকাজ চলমান। লাইন-৬ প্রকল্পে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি সাত লাখ ২১ হাজার টাকা খরচ করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বলেও জানানো হয় একনেক বৈঠকে।
এমআরটি লাইন-১ বাস্তবায়নের জন্য সময় ধরা হয়েছে ৭ বছরের কিছু বেশি, অর্থাৎ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। আর এমআরটি লাইন-৫ নির্মাণের জন্য সময় ধরা হয়েছে সাড়ে ৯ বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ১৩ হাজার ১১১ কোটি ১১ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণ ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আর এমআরটি লাইন-৫ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি ৫৪ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১২ হাজার ১২১ কোটি ৪৯ লাখ ৬৭ দেবে বাংলাদেশ সরকার এবং ২৯ হাজার ১১৭ কোটি ৫ লাখ ১০ হাজার বৈদেশিক ঋণ। সড়ক পরিহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন করবে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। প্রকল্প দুটিতে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ প্রদান করছে। প্রথমটিতেও জাইকা ঋণ প্রদান করেছে।