কয়েক মাস পরই ৫০ বছরে পদার্পণ করবে বাংলাদেশ। স্বাধীনতা ঘোষণার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উদযাপনের জন্য প্রস্তুতি পর্ব এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে বহু মুক্তিযোদ্ধাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। অনেকে মরতে মরতে বেঁচে এসেছেন। জাতি আজ সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সম্মানিত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই ৫০ বছরেও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা যায়নি। তালিকা করার নামে যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে, সেগুলোর সঠিকতা নিয়ে বারবারই প্রশ্ন উঠছে। প্রতিবারই অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অভিযোগ এসেছে। তালিকা প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ আছে। সর্বোপরি এসব প্রক্রিয়ার বহুবিধ জটিলতার কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই একে হয়রানি মনে করছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা অপমানিত ও অসম্মানিত বোধ করার মতো ঘটনাও ঘটছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়।
পঁচাত্তরের পর দীর্ঘ সময় এ দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো মূল্যায়ন ছিল না। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। তখন দেশকে ফের পাকিস্তানি ভাবাদর্শে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলেছিল। আবার স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধকারীদের বিচার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করার কিছু প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রয়োজন দেখা দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি করার। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে সেই প্রক্রিয়া। যাচাইয়ের নামে বারবার মুক্তিযোদ্ধাদের ডেকে নেওয়া, দিনব্যাপী ইউএনও অফিসের সামনে অপেক্ষা করা, অবান্তর প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) কার্যালয়ে বা মন্ত্রণালয়ে ধরনা দেওয়া, তাচ্ছিল্যের শিকার হওয়া—কি না ঘটছে এখানে। এর মধ্যে মন্ত্রণালয়ে একজন আমলার কাছ থেকে পাওয়া অপমান সইতে না পেরে একজন মুক্তিযোদ্ধা কীটনাশক পানে আত্মহত্যাও করেছেন। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন না হলে সেই ব্যক্তির পক্ষে এ অবস্থানে আসা ছিল প্রায় অসম্ভব। আবারও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তির সুপারিশ যাচাই-বাছাই করা হবে। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাজিরা দিতে হবে। কেন? ভারতীয় তালিকা আছে, লালবার্তা আছে, স্বাধীনতার পর সেনানিবাসেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ছিল এবং সেই তালিকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের এককালীন ভাতাও দেওয়া হয়েছিল। আরো বেশ কিছু নথিপত্র, তথ্য-প্রমাণ নিশ্চয়ই রয়েছে। সেসব ব্যবহার করা হয়েছে কি এই প্রক্রিয়ায়? অভিযোগ আছে, তালিকায় ওঠানোর জন্য সুপারিশ কেনাবেচা হয়। এমন হলে তা হবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার শামিল।
খুব সামান্যসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাই এখনো জীবিত আছেন। আমরা চাই, সভ্য দুনিয়া যেভাবে তাদের ‘ওয়ার হিরো’ ও অন্য বীরদের সম্মান দেয়, আমরাও যেন সেভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাতে চেষ্টা করি। এর কোনো অন্যথা যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে সহ্য করা না হয়।