কাজিরবাজার ডেস্ক :
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো ১০ এজেন্সির সিন্ডিকেট ও অনিয়ম তদন্তে গঠিত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল না করলে তাদের বিরুদ্ধেই আদালত অবমাননার দায়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তদন্তের বিষয়ে ৫টি কার্যপরিধি ঠিক করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এই কমিটিকে আগামী ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত পুনরায় সময় বেঁধে দিয়েছেন আদালত।
বুধবার (২১ আগষ্ট) বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এদিন আদালতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষে প্রতিবেদন দাখিলে সময় চাওয়া হয়।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিষ্টার রাশনা ইমাম। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশিদ আলম খান। আর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষে ছিলেন শেখ জালাল উদ্দিন।
পরে রাশনা ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, শুনানিকালে আদালত বলেছেন, ৬ মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল। এখন ১০ মাস পার হয়ে যাচ্ছে। কমিটি বারবার এসে সময় চাচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা কমিটিকে কার্যপরিধি ঠিক করে দিতে আদালতে আবেদন করি। আদালত আমাদের আবেদন মঞ্জুর করে ৫টি কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দেন।
এসব কার্যপরিধি হলো :
১. সিন্ডিকেটটা চালু ছিল ১০ মার্চ ২০১৭ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত। এই সময়ে কোন কোন রিক্রুটিং এজেন্সি শ্রমিক পাঠাতে পেরেছে, সে তথ্য দিতে হবে। এতে যদি দেখা যায় এই ১০ এজেন্সি ছাড়া অন্য কেউ শ্রমিক পাঠাতে পারেনি, তাহলে প্রমাণ হবে সিন্ডেকেট ছিল।
২. মাইগ্রেশন খরচ বাবদ প্রত্যেক শ্রমিককের কাছ থেকে কত টাকা নেওয়া হয়েছে, তা জানাতে হবে। মাইগ্রেশন খরচ সরকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা করে। এরপর এটাকে বাড়িয়ে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে সার্ভিস চার্জ নিতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে প্রত্যেক শ্রমিকের কাছ থেকে ৪ লাখ করে নেওয়া হয়েছে। এ দুই বছরে বিদেশে গেছে ২ লাখ ৮৫ হাজার শ্রমিক। তাই তদন্ত করে দেখতে হবে, এজেন্সিগুলো কত টাকা নিয়েছে।
৩. মালয়েশিয়া থেকে যখন সিদ্ধান্ত এলো ১০ এজেন্সির মাধ্যমেই শ্রমিক পাঠাতে হবে, তখন এখান থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে। ওই প্রতিবাদের মুখে এই মামলার ১১ নম্বর বিবাদী নুর আলী—(যাকে এই সিন্ডিকেটের মাষ্টারমাইন্ড বলা হচ্ছে) তিনি সরকারের কাছে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাতে বলেন, ‘এক-একটি সিন্ডিকেটের আরও ২০টি রিক্রুটিং এজেন্সি অন্তর্ভুক্ত, এতে ২০০ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সবাইকে তাতে যুক্ত করবো।’ তখন সরকার বিষয়টি অনুমোদন করে। কিন্তু আমরা (হাইকোর্ট) এটাকে তদন্ত করে দেখতে বলেছি, সব এজেন্সি মিলে শ্রমিক পাঠিয়েছিল, নাকি শুধু ১০ এজেন্সি পাঠিয়েছে।
৪. মালয়েশিয়ায় বা বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে হলে শ্রমিকদের মেডিক্যাল পরীক্ষা করতে হয়। মালয়েশিয়ার জন্য ২৬টি মেডিক্যাল সেন্টার খোলা হয়েছিল। এই ২৬টির মধ্যে ৮টি ছিল সিন্ডিকেটের। দেখা গেছে, মেডিক্যাল পরীক্ষার ফি ছিল দেড় হাজার থেকে ২ হাজার টাকা। কিন্তু তারা নিয়েছে ৫ হাজার ৩০০ টাকা করে। পাঠিয়েছে ৩ লাখের মতো শ্রমিক। আর মেডিক্যাল পরীক্ষা করানো হয়েছে ৫ লাখ শ্রমিকের। যারা যেতে পারেননি তাদের মেডিক্যাল পরীক্ষার টাকা ফেরতও দেওয়া হয়নি। এই মেডিক্যাল সেন্টারের মাধ্যমে কত টাকা আদায় হয়েছে, সেটাও তদন্ত করে আদালতকে জানাতে হবে।
৫. জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ইসরাফিল আলমসহ ৪ জন সংসদ সদস্য সিন্ডিকেটের বিষয়ে তদন্ত করতে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। বেসরকারি চ্যানেল এটিএন বাংলার একটি টকশো’তে ইসরাফিল আলম বলেছিলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত হওয়া উচিত।’ তাই শ্রমিকদের থেকে যে টাকা নেওয়া হয়েছে সেটা পাচার হয়েছে কিনা, তাও তদন্ত করে জানাতে হবে।
এছাড়া সিন্ডিকেটের অন্যান্য অনিয়মও সংশ্লিষ্ট কমিটি তদন্ত করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন হাইকোর্ট।
প্রসঙ্গত, এর আগে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যকার চুক্তি উপেক্ষা করে ১০টি এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বঞ্চিত অপর ১০টি এজেন্সি হাইকোর্টে রিট দায়ের করে।
পরে ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ন্ত্রণকারী ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট ও এর অনিয়ম তদন্তে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
সেই আদেশের ধারাবাহিকতায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
এরপর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে কয়েক দফা সময় আবেদন করায় আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং পুনরায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে আগামী ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন।