কাজিরবাজার ডেস্ক :
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় উচ্চ আদালতে রায় ঘোষণার পর প্রায় ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও বিদেশে পলাতক খুনীদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালের ১৯ নবেম্বর সর্বোচ্চ আদালতে সারাবিশ্বের আলোচিত এই হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা পাঁচ খুনীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর এবং একজন বিদেশে মারা গেলেও, বাকি ছয়জন দশ বছর ধরে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। রায় কার্যকরের আগেই ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুইয়েতে মারা যায় আসামি আজিজ পাশা। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, পলাতক খুনীদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। শীঘ্রই আমেরিকায় থাকা রাশেদ চৌধুরীর বিষয়ে সাফল্য পাওয়া যাবে। কানাডায় থাকা নুর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে মামলা করেছি। একই ধরনের অভিমত দিয়েছেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক।
উচ্চ আদালতের বিচার প্রক্রিয়া শেষে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ ও মুহিউদ্দিন আহমেদের ফাঁসি কার্যকর হয়। এর মধ্যে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি কর্নেল (অব) সৈয়দ ফারুক রহমান প্রাণভিক্ষার আবেদন করলেও সিদ্ধান্ত হয় জাতির পিতাকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধে আসামিকে প্রাণভিক্ষা দেয়া যায় না। আইনমন্ত্রী আরও বলেছেন, আমরা পলাতক খুনীদের দেশে ফেরাতে সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিবন্ধকতা অত্যন্ত শক্ত। কানাডা মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ফিরিয়ে দেয় না। সেখানকার আইনেই বলা আছে। আমরা সেখানে মামলা করেছি। ফিরিয়ে আনার জন্য তৎপরতা চলছে। অন্যদিকে আমেরিকায় থাকা আরেক খুনী রাশেদ চৌধুরী বিএনপি সরকারের আমলেই থাকার জন্য সবকিছু পাকাপোক্ত করেছে। তবে রাশেদ চৌধুরীকে দেশে আনতে শীঘ্রই সাফল্য পাব। অন্য পলাতক চারজনের বিষয়ে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। তারা পাকিস্তানে অবস্থান করছে বলে জানা গেলেও সরকারীভাবে এখনও তা নিশ্চিত করেনি দেশটি। তবে তাদেরও ফিরিয়ে আনতে টাক্সফোর্স কাজ করছে।
ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, বাংলার জনগণ বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীদের রায় কার্যকর চায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জড়িত বিদেশে পলাতক আসামিদের অবস্থান চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিদেশে বাংলাদেশে দূতাবাসসমূহ এ লক্ষ্যে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আসামিদের বিষয়ে ইন্টারপোলকে সতর্ক করা হয়েছে। সরকারের চেষ্টায় কোন রকমের গাফিলতি নেই। সরকারের প্রচেষ্টায় ভাল ফল আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার চূড়ান্ত বিচারে মৃত্যুদন্ড পাওয়া ১২ আসামির মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচবিএম নূর চৌধুরী, রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ও অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন (অব) আব্দুল মাজেদ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ১২ খুনীর মধ্যে ৫ খুনীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি যাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় তারা হলো- লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব) বজলুল হদা, লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহম্মেদ (আর্টিলারী) ও লে. কর্নেল (অব) একেএম মহিউদ্দিন আহম্মেদ (ল্যান্সার)। অপর খুনী লে. কর্নেল (অব) আজিজ পাশা ২০০২ সালে জিম্বাবুইয়েতে মারা যায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট সেনাবাহিনীর একদল উচ্চাবিলাসী সদস্যের হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে তদানিন্তন সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয়। অবশেষে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করে। একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে পলাতক খুনীদের মধ্যে নুর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছে। শরিফুল হক ডালিম পাকিস্তান অথবা হংকংয়ে অবস্থান করছে। তার পাকিস্তানের পাসপোর্ট রয়েছে বলে জানা গেছে। রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এবং আব্দুল মাজেদ চৌধুরী ভারতে, কর্নেল (অব) আব্দুর রশিদ লিবিয়া, রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হলে সরকারী চাকরিবিধি লঙ্ঘন করায় আজিজ পাশাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। একটি সূত্র জানিয়েছে শরিফুল ইসলাম ডালিম লিবিয়া ও কেনিয়ায় অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে তার যাতায়াত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ১২ সেনা কর্মকর্তাকে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে তাদের চাকরি দেয়ার পর ১৯৮০ সালে তাদেও পররাষ্ট্র সার্ভিস ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর এইচএম এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার সরকারও জিয়াউর রহমানের নীতিই অনুসরণ করেন। এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর খুনীরা বহাল তবিয়তে চাকরিসহ নানান সুবিধা ভোগ করে।