কাজিরবাজার ডেস্ক :
সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর না হওয়ায় কোরবানির চামড়া বাণিজ্যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। তবে বড় অঙ্কের বাণিজ্য রক্ষায় এবার কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। আগামী শনিবার থেকে কাঁচা চামড়া কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্যানারি মালিকরা। চামড়ার দাম কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, এতে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে। কোরবানির কাঁচা চামড়ার এই খারাপ পরিস্থিতির জন্য ট্যানারি মালিক, পাইকার ও আড়তদাররা একে অপরকে দোষারোপ করছে। তবে কাঁচা চামড়া রফতানির ঘোষণায় ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে চামড়ায় লবণ দিয়ে তা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে পাইকারি ব্যবসায়ীরা। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে কাঁচা চামড়ার দাম বেশি। এ কারণে কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতিকে সাধুবাদ জানিয়েছে পাইকার ও আড়তদাররা।
এদিকে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এবার কোরবানির চামড়া বাণিজ্যে স্মরণকালের ধস নেমেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। দাম না পেয়ে বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে চট্টগ্রামের মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লাখ লাখ পিস চামড়া রাস্তায় ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। জয়পুরহাটে হাজার হাজার পিস কাঁচা চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। খোদ রাজধানীতেও সঠিক দাম না পেয়ে ক্ষোভ জানিয়ে চামড়া ড্রেন-ডাষ্টবিনে ফেলে দিয়েছেন কোরবানি দাতারা। সরকার নির্ধারিত দাম দেশের কোথাও কার্যকর হয়নি। কোরবানির দিন সকাল থেকে ঢাকায় কাঁচা চামড়ার দামে পতন ঘটে। ঢাকায় সকালে কোন মৌসুমি ব্যবসায়ী দেখা যায়নি। কোন কোন এলাকায় কোরবানিদাতারা চামড়া নিয়ে বসে থাকলেও চামড়া কিনতে কেউ আসেনি। ফলে অনেকে দুপুরের আগেই একেবারে বিনামূল্যে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামসহ কয়েকটি সেবামূলক দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে চামড়া দিয়ে দেন। দুপুরের পর ঢাকায় কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী চোখে পড়লেও তারা লাখ লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া কেনেন মাত্র ১৫০-৩০০ টাকায়। ফলে অনেকে ক্ষোভ জানিয়ে চামড়া ড্রেন-ডাষ্টবিনে ফেলে দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের দুষলেন বাণিজ্যমন্ত্রী : চামড়ার দাম কমে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বুধবার রংপুরের শালবন এলাকায় নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের কাছে এই মন্তব্য করেন তিনি। গত কয়েক বছরের মধ্যে এবার কোরবানি হওয়া পশুর চামড়ার দাম অনেক কম। চামড়ার দামে ধস নেমেছে। এ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। চামড়া ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, এবার চামড়ার দাম স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্ন। দাম না পেয়ে অনেকেই চামড়া ফেলে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, চামড়া নিয়ে যখনই ভাল উদ্যোগ গ্রহণ করি তখনই তার বিরুদ্ধাচরণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ঈদের আগে ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তার কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। চামড়ার দাম একেবারেই কমে গেছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণেই সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, কোনভাবেই চামড়াশিল্পকে ধ্বংস করতে দেয়া যাবে না।
শনিবার থেকে কাঁচা চামড়া কিনবে ট্যানারি মালিকরা : কোরবানির চামড়া রক্ষায় আগামী শনিবার থেকে কাঁচা চামড়া কিনবে দেশের ট্যানারিগুলো। কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে কারসাজির অভিযোগের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে কাঁচা চামড়া কেনার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)। সংগঠনের সভাপতি মোঃ শাহিন আহমেদ বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে আমরা ১৭ আগষ্ট শনিবার থেকে চামড়া কেনা শুরু করব। তার আগে সকালে সংবাদ সম্মেলন করে ২০ আগষ্ট থেকে চামড়া কেনা শুরু করবেন বলে তিনি জানিয়েছিলেন।
মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল লতিফ বকসী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে অবিলম্বে নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া ক্রয় শুরু করবে ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনকে পূর্ব নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ২০ আগষ্টের আগেই জরুরী ভিত্তিতে কাঁচা চামড়া ক্রয় শুরু করার অনুরোধ জানায়। এর আগে সকালে বিটিএ’র সংবাদ সম্মেলনে শাহিন আহমেদ জানান, কাঁচা চামড়া রফতানির সরকারী সিদ্ধান্তে শতভাগ দেশীয় চামড়াশিল্প হুমকির মুখে পড়বে। এ খাতে সাত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। সাভারের আধুনিক চামড়াশিল্প নগরী প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যাবে। এছাড়া কাঁচামাল না পেলে এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে যাবে। দেখা দিতে পারে শ্রমিক অসন্তোষ। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেয়া কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিটিএ।
চামড়ার দাম কমিয়ে দেয়ার সিন্ডিকেটের সঙ্গে বিটিএ জড়িত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সংগঠনটির সভাপতি বলেন, আমরা কখনও কাঁচা চামড়া কিনি না। পাঁচ থেকে ছয় হাত বদল হয়ে ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া আসে। তাই কাঁচা চামড়ার দরপতনের সঙ্গে কোনভাবেই বিটিএ জড়িত নয়।
চামড়া নিয়ে কারসাজি খতিয়ে দেখার কথা জানালেন ওবায়দুল কাদের : কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার দাম কমার পেছনে সিন্ডিকেটের কারসাজি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
লক্ষাধিক পশুর পচা চামড়া পুঁততে হলো চসিককে : ষ্টাফ রিপোর্টার চট্টগ্রাম থেকে জানান, কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে সারাদেশে যে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে তা থেকে চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার কোন অংশই বাদ পড়েনি। অধিকাংশ এলাকায় চামড়া কেনার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। সোমবার পবিত্র ঈদ-উল-আজহার পর পশু কোরবানি চলে। পশুর চামড়া রাখতে রাখতে মঙ্গলবার পর্যন্ত ক্রেতা না পেয়ে বিপুল পরিমাণে পচন ধরে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানানো হয়েছে, তাদের এক লাখেরও বেশি চামড়া বিভিন্ন ডাম্পিং পয়েন্টে নিয়ে পুঁতে ফেলা হয়েছে। এরমধ্যে আবার অনেকে খালে-বিলে, নালা-নদীতে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছে। পচে যাওয়া চামড়ার গন্ধে বিভিন্ন এলাকায় মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। শেষ পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য অপসারণ কর্মীদের সহায়তায় তা পরিষ্কার করা হয়েছে।
সিলেটে রাস্তায় চামড়া ফেলে প্রতিবাদ : সিলেট থেকে আমাদের ষ্টাফ রিপোর্টার জানান, ২০ ট্র্রাক চামড়া ময়লার সঙ্গে ডাম্পিং স্পটে পুঁতে ফেলেছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক)। কোটি কোটি টাকা মূল্যের এই চামড়া সম্পদ বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় হতবাক নগরবাসী। মাদ্রাসাগুলোর আয়ের অন্যতম উৎস এই কোরবানির চামড়া বিক্রি করতে না পারায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। প্রতিবারের মতো এবারো ঈদ-উল-আজহায় নগরীর বিভিন্ন বাসা থেকে প্রায় ৮০০ পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছিল নগরীর খাসদবির দারুস সালাম মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। এ চামড়া বিক্রি করে যে টাকা আয় হতো তা দিয়ে মাদ্রাসার কিছুটা খরচ চলত।
রাজশাহীতে একশ’ টাকায় চামড়া বিক্রি হয়েছে : রাজশাহী থেকে ষ্টাফ রিপোর্টার জানান, রাজশাহী অঞ্চলের কোরবানির পশুর চামড়া মূল্যহ্রাসে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে এবার। এবারই প্রথম ব্যতিক্রম ঘটেছে রাজশাহীর চামড়া বাজারে। কোরবানিতে পর্যাপ্ত পশু জবাই হয়েছে। তবে চামড়ার দর মেলেনি। যারা পশু কোরবানি দিয়েছেন, তারা যেমন চামড়ার ন্যূনতম দাম পাননি, তেমনি মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও দাম পাচ্ছেন না। রাজশাহীতে সর্বনিম্ন গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে একশ টাকার কমে। আর প্রতিটি ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র ১০ টাকায়। চামড়ার এত কম দাম আগে কখনও হয় নি বলে জানিয়েছেন কোরবানিদাতারা।
শহরের বিভিন্ন এলাকার চামড়ার অস্থায়ী বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, কোরবানির গরুর প্রতি পিস ছোট চামড়ার দাম সর্বোচ্চ ২০০ টাকা, মাঝারি আকারের গরুর প্রতিটি চামড়া দেড়শ’ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর ছাগলের চামড়া ১০টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। লবণ দিয়ে সংরক্ষণের পর যা খরচ পড়বে সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করতে গেলে তার পুঁজিই উঠবে না। এদিকে, রাজশাহী জেলা চামড়া গ্রুপের সভাপতি আসাদুজ্জামান মাসুদ বলেন, এমন পরিস্থিতি সম্ভবত এই প্রথম। বলতে গেলে গরুর চামড়ার দামই নেই। আর বকরি ও খাসির চামড়ায় খাজনার চেয়ে বাজনায়ই বেশি। বকরির কাঁচা চামড়া ১০ টাকা কিনে ১৮ থেকে ২০ টাকা লাগছে লবণসহ তা সংরক্ষণের খরচ। আসাদুজ্জামান মাসুদ বলেন, বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন রাজশাহীর ব্যবসায়ীদের টাকা বকেয়া রেখেছেন। বকেয়া পাওনা রয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে রাজশাহীর চামড়া ব্যবসায়ীরা আর্থিক সঙ্কটে রয়েছেন। এছাড়া নওগাঁ, বরিশাল, মাগুরা, নীলফামারী, বগুড়া, জয়পুরহাট ও যশোর জেলায় চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে বলে জানিয়েছেন আমাদের ষ্টাফ রিপোর্টাররা।